Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Classic Header

{fbt_classic_header}

Top Ad

//

New Post:

latest

নারী নেতৃত্ব কি হারাম? ইসলামে নারী নেতৃত্ব কি জায়েয

                                     ইসলামে নারী নেতৃত্ব নাজায়েয হওয়ার শরয়ী দলিল। بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡم  الحمد لله و كفى و سلا...

                                    ইসলামে নারী নেতৃত্ব নাজায়েয হওয়ার শরয়ী দলিল।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡم الحمد لله و كفى و سلام على عباده الذين اصط
 কুরআন সুন্নাহ’র সুস্পষ্ট বর্ণনাদির ভিত্তিতে বিগত চোদ্দ শতক ধরে এ বিষয়টি উম্মাহ’র ফিকাহ্বীদগনের মাঝে কোনো রকম মতদ্বন্দ্ব ছাড়াই গৃহীত হয়ে আসছে যে, কোনো ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’র নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব কোনো নারীর হাতে সোপর্দ করা জায়েয নয়।
ইমাম ইবনে হাযাম রহ. (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) مراتب الاجماع নামে একটি কিতাব লিখেছেন; যে সব মাসআলার উপর উম্মাহ’র ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে- তিনি সেগুলোকে সেখানে সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন। তিনি সেই কিতাবে লিখিছেন- و اتفقوا ان الامامة لا تجوز لامراة –‘সকল ওলামায়ে কেরাম এব্যপারে একমত যে, কোনো নারীর জন্য ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া জায়েয নয়’। [মারাতিবুল ইজমা, ইবনে হাযাম- ১২৬ পৃষ্ঠা]
বস্তুতঃ উম্মতের এই ইজমা’র ভিত্তি কুরআন সুন্নাহ’র বহু দলিল প্রমাণের উপর স্থাপিত। আমরা সেগুলোকে এখানে পর্যায়ক্রমে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দিচ্ছি-
(১) ‘সহীহ বুখারী’ সহ বিভিন্ন ‘হাদীস গ্রন্থে’ নবী করীম ﷺ-এর নিম্নোক্ত বানীটি বিভিন্ন সহীহ ও বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে- لن يفلح قوم ولوا امرهم امراة –‘ওই জাতি কখনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না, যে জাতি তাদের বিষয়গুলোকে কোনো নারীর দায়িত্বে সোর্পদ করে দেয়’। [সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪২৫, ৭০৯৯]
এই হাদীসের মধ্যে একথাও পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুলল্লাহ ﷺ উপরোক্ত কথাটি বলেছিলেন ওই সময়, যখন ইরানের অধিবাসীরা একজন নারীকে তাদের নেত্রী বানিয়ে রেখেছিল। তাই কোনো নারীকে নেত্রী বানানো নাজায়েয হওয়ার ব্যপারে এ হাদিসটি একটি সুস্পষ্ট দলিল।

নারী নেতৃত্ব কি হারাম? ইসলামে নারী নেতৃত্ব কি জায়েয


(২) হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুলে করীম ﷺ এরশাদ করেন- اذا كانت امراءكم خياركم و اغنياءكم سمحاءكم و اموركم شورى بينكم فظهر الارض خيرلكم من بطنها و اذا كانت امراءكم شراركم و اغنياءكم بخلاءكم و اموركم الى نساءكم فبطن الارض خيرلكم من ظهرها – ‘যখন তোমাদের উৎকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধনী লোকগুলি তোমাদের দানশীলরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়আশয়গুলি তোমাদের মাঝে পরামর্শের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে, তখন জমিনের উপরিভাগ তোমাদের জন্য জমিনের গহবর থেকে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নিকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধনী লোকগুলি তোমাদের কৃপণরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়আশয়গুলি তোমাদের নারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, তখন জমিনের গহবর তোমাদের জন্য জমিনের উপরিভাগের চেয়ে উত্তম হবে’। [জামে তিরমিযী- ২/৪২]
এই হাদীসটি এতই পরিষ্কার যে, এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের কোনো প্রয়োজন নেই।

(৩) হযরত আবু বকরাহ রা. বর্ণনা করেন, রাসুলে করীম ﷺ একবার কোথাও সৈন্যদল প্রেরন করলেন। সেখান থেকে এক ব্যক্তি বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে এলে বিজয়ের সুসংবাদ শুনে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। সিজদা’র পর তিনি সংবাদ বাহকের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শুনছিলেন। সংবাদদাতা বিস্তারিত বর্ণনা দান করলেন- فكان فيما حدثه من امرا العدو و كانت تليهم امراة , فقال النبى صلى الله عليه وسلم هلكت الرجل حين اطاعت النساء – ‘উক্ত বিবরণে শত্রুদের ঘটনাবলীর মধ্যে একটি বিষয় এও ছিল যে, একজন নারী তাদের নেতৃত্ব করছিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একথা শুনে বললেন- هلكت الرجل حين اطاعت النساء ‘পুরুষরা যখন নারীদের অনুগত্য করা শুরু করে দিবে, তখন তারা বরবাদ-ধ্বংস হয়ে যাবে’। [মুসতাদরাকে হাকীম- ৪/২৯১, হাদিস ৭৮৭০]
ইমাম হাকীম রহ. এ হাদীসটিকে সহীহ সনদযুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহবীও (মৃ: ৭৪৮ হি:) একে সহীহ বলেছেন।

(৪) কুরআন কারীমে এরশাদ হয়েছে-
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ
‘পুরুষরা নারীদের উপর ‘কাউআম’ (অভিভাবক, কর্তা)। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা কতককে কতকের উপর ফজীলত দান করেছেন’। [সূরা নিসা ৩৪]
উপরোক্ত আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট করে ‘কাউমিয়াত’ (অভিভাবকত্ব ও কর্তাগিরী)-র দায়িত্ব দিয়েছেন পুরুষকে। যদিও এ আয়াতটিকে ব্যক্তিগত ব্যপারাদির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয়; কিন্তু প্রথমতঃ আয়াতটির মধ্যে এমন কোনো ‘শব্দ’ নেই, যা একে ব্যক্তিগত বিষয়াদির সাথে বিশেষ ভাবে নির্দিষ্ট করে নেয়; দ্বিতীয়তঃ এখানে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা ছোট একটি পরিবারের প্রধানত্বের দায়িত্বটুকুই যে নারী জাতির স্কন্ধে সোপর্দ করেন নি, সেখানে নারী জাতিকে সমস্ত পরিবারের লোকজন সহ গোটা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের দায়িত্বভার কি করে সোপর্দ করতে পারেন? সুতরাং এ আয়াতটি عبارة النص (ইবারাতুন্নস্/প্রত্যক্ষ দলিল) হিসেবে না হোক, دلالت النص (দালালাতুন্নস্/পরোক্ষ দলিল) হিসেবেও দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করে যে, নারীকে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের নেত্রী বানানো জায়েয নয়।
(৫) সূরা আহযাবে আল্লাহ তাআলা একজন নারীর কাজকর্মের গন্ডিসীমা পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে-
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
‘তোমরা তোমাদের নিজ নিজ ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকো এবং পূর্বের জাহেলী যুগের প্রদর্শনের ন্যয় নিজদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না’। [সূরা আযহাবঃ ৩৩]
এ আয়াতে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে যে, নারী জাতির আসল দায়িত্ব হল গৃহের দায়িত্ব। তার কর্তব্য হল, গৃহের বাহিরের কষ্ট পরিশ্রম ও সংগ্রাম থেকে নিজকে গুটিয়ে নিয়ে নিজ গৃহের সংশোধন এবং পরিবারের তরবিয়ত প্রতিপালন-পরিচর্যার মত ফরয কাজটিকে আনজাম দেয়া, যা মূলতঃ গোটা জাতি ও জীবন সংসারের বুনিয়াদ। তাই (স্বতন্ত্র অবস্থাগুলো ছাড়া) উসূল ও নীতিগত ভাবে গৃহের বাহিরের কোনো দায়িত্ব নারীর হাতে সোপর্দ করা যেতে পারে না।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে, ‘আয়াতের সম্মোধনটি বিশেষ ভাবে নবীয়ে করীম ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণের প্রতি করা হয়েছিল; সকল নারী এর ‘সম্মোধন-পাত্র’ নয়! কিন্তু এটা এত পরিষ্কার একটি ভ্রান্ত কথা যে, এজাতীয় কথা রদ্ করে দেয়ার জন্য দীর্ঘ কোনো বহছে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। প্রথমতঃ কুরআন কারীম রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণকে সম্মোধন করে বহু ব্যপারেই তাগিদ দিয়েছে। যেমনঃ তাঁরা যেন তাকওয়া অবলম্বন করেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুগত্য করেন, ফায়েশা কথাবার্তা থেকে বেঁচে চলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কোনো একটি ব্যপারও এমন নেই, যে সম্পর্কে কোনো বিবেকবান লোক একথা বলতে পারেন যে, এসমস্ত বিধান শুধুমাত্র নবীজীর পবিত্র স্ত্রীগণের জন্য, অন্য কোনো নারীর জন্য নয়। কাজেই এসকল বিধান যখন সকল নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তখন ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকার এই একটি বিধানই কেনো নবীজীর পবিত্র স্ত্রীবৃন্দের জন্য নির্দিষ্ট হবে?! দ্বিতীয়তঃ রাসুলে করীম ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণ ইলমী ও আমলী যোগ্যতাগুণের প্রশ্নে উম্মাহ’র মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নারী ছিলেন, তাঁরা গোটা উম্মাহ’র জননী ছিলেন -এ কথায় কোন্ মুসলমান সন্দেহ করতে পারে! ইসলামে যদি রাজনীতি, নেতৃত্ব, জীবিকা ও অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব কোনো নারীর হাতে সোপর্দ করা জায়েয হতই, তাহলে এ সকল পবিত্র নারীদের চেয়ে অন্য আর কোনো নারীই এই দায়িত্বের জন্য অধিক উপযুক্ত হতে পারতো না। পবিত্র কুরআন যখন তাদেরকে এজাতীয় দায়িত্ব গ্রহন করা থেকে নিষেধ করে শুধুমাত্র গৃহের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে, তখন কোন্ নারী আবার এমন থাকতে পারে, যার সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, নবীজীর পবিত্র স্ত্রীগণকে যে কারণে গৃহে আবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সে ‘কারণটি’ তার মধ্যে বিদ্যমান নেই!!!

(৬) পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবে নারীদের যে গন্ডিসীমার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ একটি হাদিসে তার ‘সমর্থিত ব্যাখ্যা’ দিয়েছেন এভাবে-
و المراة راعية على اهل بيت زوجها و ولده و هى مسئلة عنهم
‘একজন নারী হল তার স্বামীর ‘গৃহবাসী ও তার সন্তান-সন্ততির’ রক্ষনাবেক্ষনকারী। (এটাই তার জিম্মাদারী ও দায়িত্ব)। সে তাদের ব্যপারে জিজ্ঞাসীত হবে।’ [সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৩৮, ৮৯৩]
এই হাদীসে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে যে, নারীদের দায়িত্ব হল বাড়ির ব্যবস্থাপনার দেখ্ভাল্ করা, সন্তান-সন্ততির তরবিয়ত ও পরিচর্যা করা এবং ব্যক্তিগত ব্যপার-স্যপারগুলোর সুবন্দোবস্থ করা। গৃহের বহিঃর্ভাগের কোনো দায়দায়িত্ব তার কাধে সোপর্দ করা হয় নি।

(৭) ইসলামে ‘রাষ্ট্রীয় ইমামত (নেতৃত্ব)’ এবং ‘নামাযের ইমামতীর দায়িত্ব’ -এদুটো বিষয় এতই অতঃপ্রত ভাবে জড়িত যে, ‘রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব’-কেও শরীয়তের পরিভাষায় امامت (ইমামত)-ই বলা হয়ে থাকে। আর امام (ইমাম) কথাটি যেমনিভাবে নামায পড়ানেওয়ালাকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, তেমনিভাবে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’-কেও ‘ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। কুরআন হাদীসের বহু স্থানে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’কে ‘ইমাম’ শব্দ দ্বারা অবিহিত করা হয়েছে। আর ফিকাহবীদ আলেমগণ ‘ইমামত’-এর এই দ্বিবিধ অর্থকে এভাবে পার্থক্য করেন যে, নামাজের ‘ইমামতী’ কে তারা امامت صغرى (ইমামত-ই-সুগরা বা ছোট ইমামত) এবং রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকে امامت كبرى (ইমামত-ই কুবরা বা বড় ইমামত) বলে থাকেন।
তদুপরি এই প্রমাণপুষ্ট কথাটিকেও কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, নামাযের মধ্যে কোনো নারীই কোনো পুরুষের ইমামতী করতে পারবে না। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত যখন ছোট স্তরের ইমামতীর দায়িত্বই নারীর উপর ন্যস্ত করেন নি, তখন তার কাঁধে বড় স্তরের ইমামতী কি করে সোপর্দ করা যেতে পারে?
ইসলামে ‘রাষ্ট্রীয় ইমামত বা নেতৃতে’র সাথে নামাযের যে কি পরিমাণ গভীর সম্পর্ক রয়েছে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় দিয়েই তার অনুমান করা যেতে পারে-
(ক) পৃথিবীর কোনো অংশে ইসলামের হুকুমত ও কর্তৃত্ব অর্জিত হওয়ার পর اقامت صلوة (নামায কায়েম করা)-কে ‘আমীরুল মু’মিনীন (মুসলীম রাষ্ট্র প্রধান)’-এর সর্বপ্রথম ফরয দায়িত্ব বলে অবিহিত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছেঃ-
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ
‘এরা ওই সমস্ত লোক, আমি যদি তাদেরকে ভূ-পৃষ্ঠে কর্তৃত্ব দান করি, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, নেক্ কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে’’। [সূরা হজ্জ ৪১]
(খ) রাসুলে করীম ﷺ থেকে নিয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন পর্যন্ত, বরং এর পরবর্তী কয়েক যুগ পর্যন্ত ‘মুতাওয়াতির’ এই আমলটি অব্যহতভাবে চলে আসছে যে, যে জনগোষ্ঠির মধ্যে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ (তথা আমিরুল মু’মিনীন) বিদ্যমান ছিলেন, তিনিই সেই জনগোষ্ঠির ইমামতী করতেন। আর গবেষক ফুকাহায়ে কেরামগণও এ ব্যপারে একমত যে, নামাজের ইমামতীর দায়িত্ব সবার আগে মুসলীম ‘রাষ্ট্র প্রধানে’র অধিকারেই বর্তায়। রাসুলে করীম ﷺ মৃত্যুর পূর্বে রোগের কারণে যখন মসজীদে আসতে অপারগ হয়ে পড়লেন, তখন তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-কে তাঁর স্থলে নামাযের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম রা. এ থেকে একথাই বুঝে নিয়েছিলেন যে, হযরত আবু বকরের কাঁধে ছোট ইমামতের দায়িত্ব ন্যস্ত করার পিছনে এ দিকেই ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাসুলে করীম ﷺ-এর পর ‘বড় ইমামত’ তথা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত আবু বকর রা.।
হযরত আলী রা. বলেন- و انا نرى ابا بكر احق الناس بها بعد رسول الله صلى الله عليه و سلم و انه لصاحب الغار و ثانى اثنين و انا نعلم بشرفه و بكره و لقد امره رسول الله صلى الله عليه و سلم بالصلوة بالناس و هو حى – مستدرك الحاكم:ص٦٦/ج٣، و قال صحيح و هو حى على شرط الشيخين و اقره الذهبى – ‘আমরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পর লোকদের মাঝে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কেই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব্যের সবচাইতে বেশি হক্বদার বলে মনে করি। তিনি নবীজীর ‘গুহা-সাথী’, ‘দুজনের একজন’। আমরা তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানি। রাসুলুল্লাহ ﷺ জীবিত থাকতেই লোকদের নামাযে তাঁকে ইমামতী করার নির্দেশ দিয়েছেলেন। [মুসতারাকে হাকীম- ৩/৬৬]
(গ) নামাযের মধ্যে ‘আমিরুল-মু’মিনীনে’র ইমামতীর অধিকারটি শরীয়তে এত অধিক গুরুত্ব রাখে যে, ‘জানাযা নামাযে’র ইমামতীর ক্ষেত্রে ‘আমিরুল-মু’মিনীন’-কে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের উপরেও স্থান দেয়া হয়েছে। আর একথাও প্রমাণিত যে, ‘আমিরুল-মু’মিনীন’ যদি জানাযার নামাযে উপস্থিত থাকেন, তাহলে ইমামতীর সর্ব প্রথম হক্ব তাঁর; এর পরে উত্তরাধিকারদের।
এসব বিধান থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইসলামে ‘রাষ্ট্রীয় নেতৃতে’¡র সাথে নামাযের ইমামতীর এতই গভীর সম্পর্ক রয়েছে যে, ইসলামে এমন কোনো ‘রাষ্ট্র প্রধানের’ কথা কল্পনাও করা যায় না, যিনি কোনো অবস্থাতেই নামাযের ইমামতী করার উপযুক্ত নন। কোনো নারী তাকওয়া-পরহেজগারী ও পবিত্রতার প্রশ্নে যত উচ্চ মাকামের অধিকারিই হোন না কেনো, যেহেতু তিনি নামাযে পুরুষের ইমামতী করতে পারেন না, তাই তার উপর ‘বড় ইমামত ’ (তথা রাষ্ট্র প্রধানত্ব)-এর দায়িত্বও সোপর্দ করা যেতে পারে না।


(৮) ইসলামের সমস্ত বিধিবিধানের ক্ষেত্রে মোটের উপর যে বিষয়টি পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয় তা এই যে, নারীকে এমন লাবনীয় ও আকর্ষনীয় পাত্র হিসেবে অবিহিত করা হয়েছে, যাকে কোনো প্রয়োজন ছাড়া মানুষের সাধারণ সমাবেশে আসাকে কোনো অবস্থাতেই পছন্দ করা হয় নি। নবীয়ে করীম ﷺ বলেছেন- المراة عورة فاذا خرجت استشرفها الشيطان –‘নারী হচ্ছে গোপনীয় থাকার পাত্র। সে যখন বাহিরে বেড় হয়, তখন শয়তান তার পশ্চাদানুসরণে লেগে যায়।’ [জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৮৩]
একারণেই নারীকে পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সাধারণ মুসলমানদেরকে এই তাগিদ দেয়া হয়েছে যে-
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ
‘আর তোমরা যখন তাদের কাছ থেকে কিছু চাইবে, তখন পর্দার পিছন থেকে চেয়ে নাও’। [সূরা আহযাব ৫৩]
ইসলামের বহু বিধান ও ‘শিয়ার’ এমন আছে, যা ঘর থেকে বেড় হয়ে সম্পাদন করতে হয়; আর ওসব থেকে নারীদেরকে আলাদা রাখা হয়েছে। যেমনঃ জুমআর নামায। এটা কত ফজীলতের বিষয়! কুরআর হাদীসে পুরুষদেরকে এতে শরিক হওয়ার জন্য কতই না তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর সাথে রাসুলে করীম ﷺ একথাও বলে দিয়েছেন যে-
الجمعة حق واجب على كل مسلم فى جماعة الا اربعة : عبد مملوك او امراة او اصبى او مريض
‘জুমআ এমন একটি ফরয কাজ, যা জামাআতের সাথে আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। তবে তা চার ধরনের ব্যক্তি’র জন্য নয়ঃ ১. এমন গোলাম, যে কারও মালিকানাধীনে রয়েছে, ২. নারী, ৩. শিশু ৪. রোগী’। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৬৭]
এই হাদীসে জুমআর মত ‘শিয়ারে-ইসলাম’ থেকেও নারীকে আলাদা রাখা হয়েছে।
একইভাবে বলা হয়েছে যে, সাধারণ অবস্থায় এটা প্রত্যেক মুসলমানের হক্ব যে, তার মৃত্যু হলে অপরাপর মুসলমানগন তার জানাযার সাথে কবরস্থান পর্যন্ত গমন করবে। কিন্তু এ বিধান থেকেও নারীকে আলাদা রাখা হয়েছে। হযরত উম্মে আতীয়া রা. বলেন – نهينا عن اتباع الجنائز – ‘আমাদেরকে জানাযার পিছে পিছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে’। [সহীহ বুখারী- ১/১৭০]
এমনিভাবে নারীকে একাকি সফর করতেও নিষেধ করা হয়েছে, আর তাগিদ দেয়া হয়েছে তারা যেন কোনো ‘মাহরাম’ ছাড়া সফর না করে। নবীয়ে করীম ﷺ এরশাদ করেন- لا يحل لامراة تؤمن بالله و اليوم الاخر ان تسافر سفرا يكون ثلاثة ايام فصاعدا الا و معها ابوها او اخوها او زوجها او ابنها او ذو محرم منها – ‘যে নারী আল্লাহ’র উপর এবং আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, যদি তার সাথে তার পিতা বা তার ভাই অথবা তার স্বামী বা তার ছেলে কিংবা তার মাহরাম কেউ না থাকে, তবে তার জন্য তিন দিনের বা ততোধিক দূরুত্বের সফরে যাওয়া হালাল নয়’’। [জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৭৯]
এমনকি হজ্জের ন্যয় পবিত্র ফরয কাজ -যা ইসলামের ‘আরকান চতুষ্টয়ে’র মধ্যে অন্যতম, তা আদায়ের জন্যেও (নারীর সাথে) ‘মাহরাম’ কেউ থাকা শর্ত। নারীর একাকি ‘হজ্জ সফরে’ যাওয়া কারও মতেই জায়েয নয়। এধরনের পরিস্থিতিতে তার উপর হজ্জ আদায়ের দায়িত্ব বিদ্যমান থাকে না। মৃত্যু পর্যন্ত এ রকম কোনো মাহরাম পাওয়া না গেলে তাকে হজ্জ আদায় করতে হবে না। অবশ্য বদলী হজ্জের জন্য সে ওসিয়ত করে যাবে।
ইসলামী রোকন সমূহের মধ্যে ‘জীহাদ’ কত গুরুত্বপূর্ণ একটি রোকন! জীহাদের ফজীলত দিয়ে কুরআন হাদীস ভরে আছে। কিন্তু এটা যেহেতু গৃহের বাহিরের একটি কাজ, তাই জীহাদের মত ‘ফরয’ কাজটিকেও নারী জাতির দায়িত্ব থেকে বাহিরে রাখা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো কোনো হাদীসে এসেছে- ليس على النساء غزو و لا جمعة و لا تشبيع جنازة – ‘নারীর দায়িত্বে না আছে জীহাদ, না জুমআর নামায, আর না জানাযার পিছে পিছে যাওয়া’। [তাবরানীঃ মাজমাউয-যাওয়াইদ- ২/১৭০; ফাতহুল কাবীর- ৩/৬১]
এমন কি একবার হযরত উম্মে সালমাহ রা. জীহাদের আগ্রহের কারনে নবীয়ে করীম ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন- يغزوا الرجال و لا تغزو النساء – ‘পুুরুষরা জীহাদ করে, নারীরা কি জীহাদ করবে না?’ এর পরিপ্রেক্ষিতে কুরআন কারিমের এই আয়াতটি নাজিল হয়- و لا تتمنوا ما فضل الله به بعضكم على بعض –‘আর তোমরা ওই বিষয়ের আকাঙ্খা পোষন করো না, যা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তোমাদের মধ্য থেকে কতোককে কতোকের উপর ফজীলত দান করেছেন’। [জামে তিরমিযী, হাদীস ৫০১১; মুসনাদে আহমদ- ৬/৩২২]
একথা ঠিক যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জামানায় কোনো কোনো নারী জীহাদে আহতদের ঔষধ-পট্টি প্রভৃতির বন্দোবস্থ করার জন্য সাথে গিয়েছিলেন। কিন্তু কথা হল, প্রথমতঃ তাদের উপর নিয়মানুগ ভাবে জীহাদকে ফরয করা হয় নি; দ্বিতীয়ঃ তাদেরকে নিয়মানুগ ভাবে যুদ্ধেও শামিল করা হয় নি। যেমন, হযরত আব্দুলল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- و قد كان يغزوبهن فيداوينالجرحى يحذين من الغنيمة و اما بسهم فلم يضرب لهن – ‘রাসুলুলল্লাহ ﷺ মহিলাদেরকে জীহাদে নিয়ে যেতেন। তারা আহতদের সেবাশশ্রুষা করতো। তাদেরকে ‘গনীমতের মাল’ থেকে পুরষ্কার স্বরুপ কিছু দেয়া হত বটে, কিন্তু তিনি তাদেরকে গনীমতের নিয়মানুগ অংশে শরীক করতেন না’। [সহীহ মুসলীম, হাদীস ৪৪৪৮]
যদিও বা-রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর জামানায় নারীদেরকে রাতে মসজীদে নববীতে এসে জামাতে নামায পড়ার অনুমতি দিতেন, কিন্তু উক্ত অনুমতির সাথে সাথে তিনি একথাও বলতেন যে- و بيوتهن خيرلهن – ‘তাদের জন্য তাদের গৃহই উৎকৃষ্ট স্থান’। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৬৭, ৫৬৮]
এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, নারীদের জন্য ঘরে একাকি নামাজ পড়া মসজীদে নামায পড়া থেকে অধিক ফজীলতপূর্ণ। অথচ পুরুষদের জন্য শক্ত ওজর ছাড়া মসজীদের জামাত তরক করা জায়েয নয়। রাসুলে করীম ﷺ নারীদের ব্যপারে এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে- و صلات المراة فى بيتها افضل من صلاتها فى حجرتها و صلاتها فى مخدعها افضل من صلاتها فى بيتها – ‘একজন নারীর জন্য তার ঘরে নামায পড়া তার হুজরায় নামায পড়া হতে অধিক ফজীলতপূর্ণ। আবার তার কামড়ার অন্দর মহলে নামায পড়া তার ঘরে নামায পড়া হতে অধিক ফজীলতপূর্ণ’। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৭০]
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে যে কথাটি পরিষ্কার হয়ে যায়, তা এই যে-
১. নারীর উপর জুমআর নামায ওয়াজিব নয়।
২. নারীর জন্য মাহরাম ছাড়া সফর করা জায়েয নয়।
৩. নারীর জন্য একাকি অবস্থায় হজ্জ আদায় করা ফরয নয়। মৃত্যু পর্যন্ত ‘মাহরাম’ পাওয়া না গেলে সে বদলী হজ্জের ওসিয়ত করে যাবে।
৪. নারীর উপর জীহাদ ফরজ নয়।
৫. নারীর জন্য জামাআতের সাথে নামায পড়া ওয়াজিব নয়।
৬. নারীর জন্য ঘরে একাকি নামায পড়া বাইরে জামাআতের সাথে নামায পড়া হতে অধিক ফজীলতপূর্ণ।
এখন ভেবে দেখার বিষয়, যে ‘দ্বীন ইসলাম’ নারীর পবিত্রতা এবং তার ইজ্জত আব্রু হিফাজতের উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, দ্বীনের বড় বড় ‘আরকান’ ও ‘শিয়ার’-কেও তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেই দ্বীন সম্পর্কে একথা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে, দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নারীর কাঁধে সোপর্দ করে সে তাকে রাষ্ট্রের সামনেই শুধু নয় বরং গোটা পৃথিবীর সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিবে !!! আর সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য তার কাঁধে ওই সমস্ত কাজ কারবার ন্যস্ত করবে, যেসব কাজের দায়িত্ব তার উপর ব্যক্তি পর্যায়গতভাবেও আরোপিত হয় না!!!
দু’জাহানের সর্দার রাসুলে করীম ﷺ-এর যুগ থেকে নিয়ে খুলাফায়ে রাশেদাহ বরং ‘খুলাফায়ে রাশেদাহ’র পরেও কয়েক যুগ পর্যন্ত ‘খলীফা’ ও ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ নির্বাচন বিষয়টি উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গোন পরিগ্রহ করেছে। এক খলীফার পর অন্য খলীফা নির্বাচনের সময় প্রত্যেক ক্ষেত্রে বহু মতামত সামনে এসেছে। সে যুগে এমন অসংখ্য নারী বিদ্যমান ছিলেন, যারা তাদের ইলম, ফজল, পবিত্রতা, পরহেজগারী ও বিবেক-বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে অনন্য পর্যায়ের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু কোনো নারীকে যে কখনই রাষ্ট্র প্রধান বানানো হয়নি- ব্যপার শুধু তাই নয়, বরং তখন নিম্ন স্তরের এমন কোনো মতামতও সামনে আসেনি যে, অমুক নারীকে ‘খলীফা’ বানানো হোক। এটা একথারই সুস্পষ্ট দলিল যে, এ ব্যপারে কুরআন-সুন্নাহ’র আহকাম এতটাই পরিষ্কার ছিল যে, কখনো কোনো মুসলমানের অন্তরে নারীকে ‘খলীফা’ বানানোর সামান্য খেয়ালটুকু পর্যন্ত আসেনি। আর আসবেই-বা কেমন করে, যখন ইসলামে এমন কোনো পুরুষের কথা চিন্তাই করা যায় না, যে পুরুষ-
১. কোনো অবস্থাতেই নামাযের ইমামতী করতে পারে না।
২. যার জামাতের সাথে নামায পড়ার বিষয়টি পছন্দসই নয়।
৩. কখনো সে যদি জামাতে এসে জুড়ে, তবে তাকে সকল পুরুষের পিছনে দাঁড়াতে হয়।
৪. যার প্রত্যেক মাসে কয়েক দিন করে এমন কিছু বেড় হয়, যখন তার জন্য মসজীদে প্রবেশ করা জায়েয থাকে না।
৫. যার উপর জুমআ ফরয নয়।
৬. যার কোনো জামাযার সাথে যাওয়া জায়েয নেই।
৭. যে মাহরাম ছাড়া সফর করতে পারে না।
৮. যে একাকি হজ্জে যেতে পারে না।
৯. যার উপর জীহাদ ফরয নয়।
১০.যার স্বাক্ষ্যকে অর্ধেক স্বাক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়।
১১. যার জন্য অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বেড় হওয়া জায়েয নয়।
১২. যার ‘ভাত-কাপড়’ বিয়ের আগে পিতার উপর এবং বিয়ের পর স্বামীর উপর ওয়াজিব থাকে।
১৩. যে কারো বিয়েতে ওলী হতে পারে না।
১৪. আর তার গন্ডি সীমা তো এই যে, সে খোদ্ তার ঘরেও ‘ঘর প্রধান ’ হওয়ার আসনটুকুও লাভ করতে পারে না।
উম্মাহ’র ইজমা (ঐক্যমত)
কুরআন সুন্নাহর উপরোল্লখীত দলিল প্রমাণগুলোর কারণে বিগত চোদ্দ’শ বৎসরের মধ্যে প্রত্যেক যুগেই এ কথার উপর ‘উম্মতে মুসলিমা’র ইজমা (ঐক্যমত) চলে আসছে যে, ইসলামে ‘রাষ্ট্র প্রধানত্বে’র দায়িত্বভার কোনো নারীর কাঁধে সোপর্দ করা জায়েয নয়। আর উম্মতের ইজমা হল শরীয়তের স্বতন্ত্র একটি দলিল।
‘ইজমা’ প্রমাণের জন্য আমরা আলোচনার শুরুতেই আল্লামা ইবনে হাযাম রহ.-এর বক্তব্য উদ্বৃত করে এসেছি। তিনি যে কিতাবটিকে শুধুমাত্র ‘ইজমা’ সম্পর্কিত মাসআলাগুলোর তাহক্বীক্ব পেশ করার জন্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তাতে তিনি একথা বলেছেন যে- و اتفقوا ان الامامة لا تجوز لامراة – ‘সকল আলেম সমাজ এব্যপারে একমত যে, কোনো নারীর জন্য ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া জায়েজ নয়’। [মারাতিবুল ইজমা, ইবনে হাযাম- ১২৬ পৃষ্ঠা]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহঃ (মৃঃ ৭২৮ হিঃ)-এর ন্যয় বিজ্ঞ আলেম আল্লামা ইবনে হাযাম রহ.-এর উল্লেখিত কিতাবের উপর نقد مراتب الجماع নামক একটি সমালোচনামূলক কিতাব রচনা করেছেন এবং তাতে এমন কিছু মাসআলার উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে আল্লামা ইবনে হাযাম ‘ইজমা’ বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’র গবেষনা ও তাহক্বীক্ব মতে ওগুলো ইজমা নয়। বরং ওগুলোর ব্যপারে কারো না কারো মতভিন্নতা রয়েছে। সেই কিতাবেও ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. নারী নেতৃত্বের পশ্নে আল্লামা ইবনে হাযামের কোনো বিরোধীতা করেন নি। [দেখুন: নাক্বদু মারাতিবিল ইজমা, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১২৬ পৃষ্ঠা ]
এসকল হযরতগন ছাড়াও যে সকল উলামা, ফুকাহা এবং ইসলামী রাজনীতি বিশেষজ্ঞমন্ডলী ‘ইসলামী রাজনৈতিক’ ব্যবস্থার উপর গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই এই মাসআলাটিকে একটি সর্বসম্মত মাসআলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহঃ (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ)-এর গ্রন্থকে ‘ইসলামী রাজনীতি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্- গ্রন্থ বলে মনে করা হয়ে থাকে। সেখানে তিনি ‘রাষ্ট্রীয় নের্তৃত’ তো পরের কথা, নারীর উপর (সাধারণ) মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পর্যন্ত সোপর্দ করাকে নাজায়েয বলে অবিহিত করেছেন। বরং তিনি মন্ত্রীত্বকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটি হল وزارت تفويض (ওযারাতে তাফুউইজ); এই মন্ত্রী ব্যবস্থায় (রাষ্ট্রীয়) ‘পলিসী/নীতিমালা’ নির্ধারন করাও মন্ত্রীর কাজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়টি হল وزارت تنفيذ (ওযারাতে তানফিজ); এরকম মন্ত্রী কোনো পলিসী তৈরী করে না, বরং পূর্ব নির্ধারিত পলিসীকে কার্যকর করে। ইমাম মাওয়ারদী বলেছেন যে, ‘ওযারাতে তানফিজ’-এর মধ্যে মন্ত্রীত্বের শর্ত শরায়েত ‘ওযারাতে তাফুউইজ’ এর তুলনায় কম বা হালকা। এতদ্বসত্ত্বেও তিনি ‘ওযারাতে তানফিজ’-এর দায়িত্ব কোনো নারীর হাতে সোর্পদ করাকেও জায়েয বলেন নি। তিনি লিখেছেন-
و ما وزارة التنفيذ فحكمها اضعف و شروطها اقل و لا يجوزان ان تقوم بذلك امراة و ان خبرها مقبولا لما تضمنه معنى الولايات المصروفتة عن النساء لقول النبى صلى الله عليه و سلم ما افلح قوم اسندوا امرهم الى امراة و لان فيها من طلب الراى و ثبات العزم ما تضعف عنه النساء و من الظهور فى مباشرة الامور ما هو عليهن محظور٠٠٠الاحكام السلطانيه للماوردى : ص٧٢٥ / ج٢
‘ওযারাতে তানফিজ’ সম্পর্কে কথা হল, এর বিধিবিধানগুলো (ওযারাতে তাফুউইজ থেকে) তুলনামূলক হালকা এবং এর শর্তশরায়েতও অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু কোনো নারীর জন্য এ দায়িত্ব গ্রহন করাও জায়েয নয়-চাই সেই নারীর অবস্থা যত গ্রহনযোগ্যই হোক না কেনো। কেননা, এ ধরনের মন্ত্রীত্বও এমন এক অভিভাবকত্ব্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগিত হয়, যে অভিভাবকত্ব্যকে (শরীয়ত) নারী জাতি থেকে পৃথক রেখেছে। কেননা, রাসুলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন যে- যে জাতী তাদের বিষয়আসয়গুলোকে কোনো নারীর উপর সোপর্দ করে দেয়, তারা সফলকাম হতে পারবে না। তদুপরি এজন্যেও যে, এধরনের মন্ত্রীত্বের জন্য যে পরিপক্ক সিদ্ধান্ধ ও সুদৃঢ় অবিচলতা দরকার, তা নারী জাতির মধ্যে দূর্বলমাত্রায় পাওয়া যায়। তাছাড়া এ ধরনের মন্ত্রীত্বের ফরয দায়িত্ব আনজাম দেয়ার জন্য তাকে সর্বসাধারণ জনতার সামনে প্র্রকাশ্যে এমনভাবে আসতে হয়, যা নারীদের জন্য শরয়ীভাবে নিষিদ্ধ’। [আল আহকামুস সুলতানীয়্যাহ, মাওয়ারদী- ২/৭২৫]
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন ইমাম আবু ইয়ালা হাম্বলী রহঃ। তিনিও তাঁর গ্রন্থে হুবহু একথাগুলোই বলেছেন।
ইমামুল হারামাঈন হযরত যুওয়াইনী রহঃ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর বড়ই বৈশিষ্টমন্ডিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি নিজামুল মুল্ক্ তুসী রহ.-এর মত নেককার প্রশাসকের জামানার লোক ছিলেন। তারই আবেদনে ইমামুল হারামাঈন রহ. ইসলামের রাজনৈতিক বিধিবিধান সম্বলিত স্বীয় মুজতাহীদসূলভ গ্রন্থ غياث الامم লিপিবদ্ধ করেন। তাতে তিনি ইসলামী সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন শর্ত বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন-
و من الصفات الازمة المعتبرة الذكورة و الحرية و نحيزة العقل والبلوغ ولا حاجة الى الاطناب فى نصب الدلالات على اثبات هذه الصفات
‘রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার জন্য শরয়ীভাবে গ্রহনযোগ্য যে সকল বৈশিষ্ট তার থাকা অপরিহার্য, সেগুলো হলঃ পুরুষ হওয়া, স্বাধীন হওয়া এবং আকেল (বোধজ্ঞানসম্পন্ন) ও বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া। আর এ সমস্ত শর্তাবলী প্রমাণ করার জন্য বিস্তারিত দলিল প্রমাণ পেশ করে আলোচনা দীর্ঘায়ীত করার প্রয়োজন নেই। [গায়াছুল আম্মাম, যুওয়াইনী- ৮২ পৃষ্ঠা]
এই ইমামুল হারামাঈনই তাঁর আরেক কিতাব الارشاد فى اصول الاعتقاد -এ লিখেছেন-
و اجمعوا ان المراة لا يجوزان تكون اماما و ان اختلفوا فى جواز كونها قاضية فيما يجوز شهادتها فيه
‘আর এব্যপারে সকলেই একমত যে, নারীকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বানানো জায়েয নয়। অবশ্য যে সব ক্ষেত্রে কোনো নারী সাক্ষ্য দান করতে পারবে, সেসব ক্ষেত্রে সে কাজী (বিচারক) হতে পারবে কি না -সে ব্যপারে মতভিন্নতা রয়েছে’। [আল ইরশাদ ফি উসূলীল ই’তিক্বাদ, ইমামুল হারামাঈন- ৩৫৯, ৪২৭ পৃষ্ঠা]
আল্লামা ক্বালকাশানদীকে সাহিত্য রচনা এবং ইতিহাস ও রাজনীতির ইমাম মনে করা হয়ে থাকে। তিনি ইসলামের রাজনৈতিক উসূলসমৃদ্ধ যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাতে রাষ্ট্র প্রধানের চোদ্দটি যোগ্যতা গুণের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন। শর্তগুলোর একেবারে প্রথমেই তিনি লিখেছেন-
الاول الذكورة—– و المعنى فى ذالك ان الامام لا يستغنى عن الاختلاط بالرجال و المشاورة معهم فى الامور والمراة ممنوعة من ذالك و لان المراة ناقصة فى امر نفسها حتى لا تملك النكاح فلا تجعل اليها الولاية على غيرها
‘প্রথম শর্ত হলঃ তাকে পুরুষ হতে হবে। এ বিধানের পিছনে হেকমত এই যে, একজন রাষ্ট্র প্রধানের পক্ষে পুরুষদের সাথে মেলামেশা করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করা থেকে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভবই নয়। অথচ একজন নারীর জন্য তা নিষিদ্ধ। এছাড়াও একজন নারী তার নিজের অভিভাবকত্বের প্রশ্নেও দূর্বল; এমনকি সে বিয়ের অবিভাবকও হতে পারে না। সুতরাং তাকে অন্যদের উপরও অবিভাবক বানানো যেতে পারে না’। [মাআছিরুল ইনাফা ফি মাআলেমিল খিলাফহ, ক্বালকাশানদী- ১/৩২]
ইমাম বগভী রহ. (মৃঃ ৫১৬ হিঃ) হলেন পাঁচ’শত হিজরীর একজন সুবিখ্যাত মুফাসুসীর, মুহাদ্দিস এবং ফিকাহ শ্বাস্ত্রবীদ। তিনি বলেছেন-
اتفقوا على ان المراة لا تصلح ان تكون اماما…….لان الامام يحتاج الى الخروج لاقامة امر الجهاد والقيام بامور المسلمين…….. و المراة عورة لا تصلح للبروز
‘মুসলীম উম্মাহ এ ব্যপারে একমত যে, নারীর জন্য ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া জায়েয নয়। …. কেননা ‘রাষ্ট্র প্রধান’-কে জীহাদ সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যপারগুলোকে আনজাম দেওয়ার জন্য বাহিরে বেড় হওয়ার মুকাপেক্ষি হয়ে পড়তে হয়। …..অথচ নারী হল গোপন থাকার বস্তু। সর্বসাধারণের সমাবেশে আসা তার জন্য জায়েয নেই’। [শারহুস সুন্নাহ, বগভী- ১০/৭৭]
ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহ. হযরত আবু বকরাহ রা.-এর হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন-
و هذا نص فى ان المراة لا تكون خليفة و لا خلاف فيه
‘হাদীসটি এ কথারই দলিল যে, নারী খলীফা (রাষ্ট্র প্রধান) হতে পারবে না। এ ব্যপারে কোনোই দ্বিমত নেই। [আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ৩/৪৪৫]
ইমাম কুরতুবীও তার তাফসীর গ্রন্থে ইবনুল আরাবীর উপরোক্ত মন্তব্যটি উল্লেখ করে তার সমর্থন করেছেন এবং বলেছেন, এ মাসআলা সম্পর্কে আলেমগনের মাঝে কোনোই মতদ্বন্দ্ব নেই। [তাফসীরে কুরতুবী- ১৩/১৮৩; সূরা নামল ]
ইমাম গাযালী রহ. বলেছেন-
الرابع الذكورية فلا تنعقد الامامة لامراة و ان اتصفت بجميع خلال الكمال و صفات الاستقلال
‘রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার চতুর্থ শর্ত হল- পুরুষ হওয়া। সুতরাং কোনো নারীর নেতৃত্ব গ্রহনযোগ্য নয়- চাই সে যাবতীয় গুণে গুণান্বিতই হোক এবং ধৈর্য-বীর্যের সমস্ত গুণই তার মধ্যে থাকুক না কেনো। [ফাজাইহুল বাতিনিয়্যাহ, গাযালী- ১৮০ পৃষ্ঠা]
আকাঈদ ও কালাম শ্বাস্ত্রের সম্ভাব্য সমস্ত কিতাবেই রাষ্ট্র প্রধানত্বতা এবং ইসলামী রাজনীতির বিধিবিধান সম্পর্কিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। তাদের সকলেই ‘পুরুষ’ হওয়ার শর্তটিকে একটি ‘ইজমায়ী’ (ঐক্যমতে উপনীত) শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা তাফতাযানী রহ. লিখেছেন –
يشترط فى الامام ان يكون مكلفا حرا ذكرا عدلا
‘রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার জন্য শর্তগুলো হলঃ আকেল ও বালেগ হওয়া, স্বাধীন হওয়া, পুরুষ হওয়া এবং ন্যয়পরায়ন হওয়া’। [শারহুল মাকাসিদ- ২/৭৭]
ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন এবং ইসলামী রাজনীতির উলামায়ে কেরামের এই যৎসামান্য উদ্ধতিগুলি নিছুক নমুনা স্বরূপ পেশ করা হল। নচেৎ যে কিতাবেই ইসলামে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়ার শর্তসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ‘পুরুষ’ হওয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কেউ এই শর্তটিকে উল্লেখ না করে থাকেন, তাহলে সেটা এ জন্যেই করেছেন যে, এ শর্তটিও ‘আকেল ও বালেগ’ হওয়ার শর্তের মত এতই প্রসিদ্ধ ও পরিজ্ঞাত একটি শর্ত যে, সেটাকে নিযমতান্ত্রিক ভাবে উল্লেখ করারও প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। অন্যথায়, এ মাসআলা নিয়ে কোনোই মতদ্বন্দ্ব নেই।
বর্তমান কালের কয়েকজন গবেষক আলেম -যাঁরা ‘ইসলামী রাজনীতি’র উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন, তারাও এব্যপারে একমত যে, নারীর ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া নাজায়েয হওয়ার ব্যপারে মুসলীম উম্মাহ’র ‘ইজমা’ রয়েছে। আমরা নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি।
ডঃ মুহাম্মাদ মুনীর আযলানী লিখেছেন-
لا نعرف بين المسلمين من اجاز خلافة المراة فالاجماع فى هذه القضية تام لم يشذ عنه احد
‘মুসলমানদের মধ্যে এমন কোনো আলেমের কথা আমাদের জানা নেই, যিনি নারীর খলীফা (রাষ্ট্র প্রধান) হওয়াকে জায়েয বলেছেন। বস্তুতঃ এ মাসআলার উপর ‘মুকাম্মেল ইজমা’ (পূর্ণাঙ্গ ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যার বিপরীতে কারো থেকে কোনো ‘শাজ’ (স্বতন্ত্র ও একক) অভিমত বিদ্যমান নেই’। [আবকারিয়াতুল ইসলাম ফি উসুলিল হুকম- ৮০ পৃষ্ঠা]
ডঃ মুহাম্মাদ জিয়াউদ্দীন আররাইস ইসলামী রাজনীতির বিধিবিধানের উপর অত্যন্ত তাহক্বীক্ব করে বিস্তারিত একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন-
اذا كان قد وقع بينهم خلاف فيما يتعلق بالقضاء فلم يرو عنهم خلاف فيما يتعلق بالامامة بل الكل متفق على انه لا يجوز ان يليها امراة
‘যদিও ফিকাহবীদ আলেমগনের মাঝে ‘বিচার’ সম্পর্কে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে (যে, কোনো নারী বিচারক হতে পারবে কি-না), কিন্তু (নারীর) ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া নিয়ে তাঁদের মাঝে কোনো রকম মতভিন্নতা নেই। বরং তাঁদের সকলেই এ ব্যপারে একমত যে, কোনো নারীকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ করা জায়েজ নয়। [আন নাজরিয়াতুস সিয়াসিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ- ২৯৪ পৃষ্ঠা]
ডঃ ইবরাহীম ইউসূফ মুস্তাফা আযওয়া (عجو) লিখেছেন-
مما اجمعت عليه الامة لا يجوز لها ان تلى رياست الدولة
‘এ ব্যপারে মুসলীস উম্মাহ একমত যে, কোনো নারীর জন্য রাষ্ট্রের নেতৃত্ব্য ও কর্তৃত্ব গ্রহন করা জায়েয নয়। [তা’লীক তাহযিবুর রিয়াসাত ওয়া তারতিবিস সিয়াসাত- ৮২ পৃষ্ঠা]
আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন সুলাইমান আর-রমিযী (الرميجى) লিখেছেন-
من شروط الامام ان يكون ذكرا و خلاف فى ذالك بين العلماء
‘রাষ্ট্রে প্রধান হওয়ার জন্য যে সব শর্তাবলী রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল পুরুষ হওয়া। এ ব্যপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে কোনো রকম মতদ্বন্দ্ব নেই। [আল ইমামাতুল আজমা ইনদা আহলিসসুন্নাহ- ২৪৩ পৃষ্ঠা]
বর্তমান যুগের বিখ্যাত ‘মুফাসসিরে কুরআন’ আল্লামা মুহাম্মাদ আমীন শানক্বিতী রহ. লিখেছেন-
من شروط الامام الاعظم كونه ذكرا و لا خلاف فى ذالك بين العلماء
‘রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার জন্য যেসব শর্তাবলী রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তাকে পুরুষ হতে হবে। এ ব্যপারে ওলমায়ে কেরামের মাঝে কোনো মতবিরোধ নেই। [আজওয়াউল বায়ান ফি তাফসীরিল কুরআন বিল কুরআন- ২/৬৫]
যদি এ বিষয়ের উপর ইসলামী ইতিহাসের আইম্মাহ, মুফাসসিরীন, ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন, মুতাকাল্লিমীন এবং গবেষক পন্ডিতবৃন্দের যাবতীয় বক্তব্যমালাকে একত্র করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা দিয়ে একটি বিরাট গ্রন্থ তৈরী হয়ে যাবে। কিন্তু যৎসামান্য এই নমুনাগুলোই একথা প্রমান করার জন্য যথেষ্ট যে, এ মাসআলা নিয়ে উলামায়ে ইসলামের মাঝে আজ পর্যন্ত চোদ্দ’শ বৎসরে কোনো মতভিন্নতা দেখা দেয় নি।
ইমাম আবু জা’ফর মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী রহঃ (মৃঃ ৩১০ হিঃ)-এর মাসলক
আমাদের এ যুগের কেউ কেউ এ কথাটিকে বিখ্যাত ‘মুফাসসীরে কুরআন’ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ.-এর দিকে ভুল করে সংযুক্ত করে দেয় যে, তিনি (নাকি) ‘নারী নেতৃত্ব’ জায়েয হওয়ার প্রবক্তা। কিন্তু কেউই ইমাম ইবনে জারীরের নিজেস্ব কোনো উদ্ধৃতি পেশ করেন না। তাঁর রচনা সামগ্রীর মধ্যে ‘তাফসীরে জামেউল বয়ান’ (তাফসীরে তাবারী) ৩০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত সেখান থেকে কেউই কোনো একটি বাক্য পর্যন্ত দেখাতে পারলো না, যা থেকে তাঁর এ অবস্থানের বিষয়টি জানা যায়। স্বয়ং আমরাও তার তাফসীরের সম্ভাব্য স্থানগুলির উপর দৃষ্টি বুলিয়েছি। কিন্তু সেখানে কোথায়ও এরকম কোনো কথা পাওয়া যায় নি। এ কিতাবটি ছাড়াও তার আরেকটি কিতাব ‘তাহযীব’-এর কয়েকটি খন্ডও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও এরকম কোনো কথা পাওয়া যায় নি।
ঘটনা হল, কতিপয় আলেম তাঁর এই মাসলকের কথা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি নারীকে কাজী (বিচারক) বানানো জায়েয বলেন। কোনো কোনো লোক একথাটিকেই ভুল করে ‘নেতৃত্ব’ জায়েয হওয়ার প্রসঙ্গে উল্লেখ করে দিয়েছেন। যেমন ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহ. লিখেছেন-
و هذا نص فى ان المراة لا تكون خليفة و لا خلاف فيه و نقل عن محمد بن جرير الطبرى امام الدين انه يجوزان تكون المراة قاضية و لم يصح ذالك عنه و لعله كما نقل عن ابى حنيفة انها انما تقضى فيما تشهد فيه و ليس بان تكون قاضية على الاطلاق ولا بان يكتب لها منشور بان فلانة مقدمة على الحكم الا فى الدماء والنكاح و انما ذالك كسبيل التحكيم او الاستبانة فى القضية الواحدة
‘আর হযরত আবু বকরাহ রা.-এর হাদীসটি একথারই দলিল যে, ‘নারী’ খলীফা হতে পারবে না। এ নিয়ে কোনো মতবিরোধ নেই। তবে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে জরীর তাবারী রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর মতে নারীর জন্য বিচারক (কাজী) হওয়া জায়েয। কিন্তু তাঁর প্রতি এ মতটি সম্পৃক্ত করে দেয়া শুদ্ধ নয়। সম্ভবতঃ তাঁর মতটি এমনই, যেমন ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, একজন নারী যে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে পারে, সেই ব্যপারে সে ফয়সালাও দিতে পারবে। তার অর্থ এই নয় যে, সে সম্পূর্ণরূপে একজন বিচারক হয়ে যাবে (এবং বিচারকের বিচারকার্য সেও পরিচালনা করতে পারবে)। এর অর্থ এও নয় যে, তাকে বিচারকের পদে নিয়োগ দেওয়ার পরওয়ানা দেওয়া হবে এবং বলা হবে যে, অমুক নারীকে ‘কিসাস’ ও ‘বিবাহ’-এর ব্যপারাদি ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলিতে বিচারক বানানো হচ্ছে। বরং এর অর্থ এই যে, তাকে কোনো একটি ব্যপারে শালিশ বানিয়ে নেয়া যাবে কিংবা শাখাগত ভাবে তার উপর কোনো একটা মুকাদ্দামা সোপর্দ করা যাবে’। [আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ৩/৪৪৫]
ইমাম ইবনুল আরাবীর বিবরণ থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সামনে আসে-
১. ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়ার মাসআলাহ্ আলাদা, আর বিচারক হওয়ার মাসআলাহ্ আলাদা।
২. ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বিষয়ক মাসআলা সম্পর্কে ইমাম ইবনে জারীর সহ সকল আলেম এ ব্যপারে একমত যে, কোনো নারী ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হতে পারবে না।
৩. ইমাম ইবনে জারীর রহ. থেকে ‘বিচারক’ হওয়া জায়েয হওয়ার কথা বর্ণিত আছে বটে, তবে এ কথাটি তার প্রতি সম্পৃক্ত করা সঠিক নয়।
৪. ইমাম আবু হানীফা রহ. এবং ইমাম ইবনে জারীর রহ. থেকে কোনো মুকাদ্দমায় নারী কতৃক রায় দান জায়েয হওয়া সম্পর্কিত যে কথাটি বর্ণিত আছে, সেটা তাকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে (পূর্ণাঙ্গরূপে) বিচারক বানানো প্রসঙ্গে নয়, বরং তা (নিছক) শাখাগত ভাবে শালিশ স্বরূপ কোনো ব্যক্তিক পর্যায়ের ফয়সালা দান প্রসঙ্গের।
যাহোক, ফিকাহবীদগনের মাঝে সামান্য কোনো মতপার্থক্য যদি থেকে থাকে, তবে সেটা রয়েছে নারীকে বিচারক বনানো প্রসঙ্গে; ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বানানোর ব্যপারে তাদের মাঝে কোনোই মতপার্থক্য নেই। যেমন ইমামুল হারামাঈন যুত্তয়াইনী রহ. লিখেছেন-
و الذكورة لا شك فى اعتبارها و من جوز من ابعلماء تولى المراة للقضاء فيما يجوز ان تكون شهادة فيه احال انتصاب المراة للمامة فان القضا قد يثبت مختصا والامامة يستجيل فى وضع الشرع ثبوتها على الاختصاص
‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া যে শর্ত -এ ব্যপারে কোনোই সন্দেহ নেই। আর যে সব ক্ষেত্রে একজন নারী সাক্ষী হতে পারে, যে সকল উলামায়ে কেরাম ওসব ক্ষেত্রে তার বিচারক হওয়াকে জায়েয বলেছেন, তাঁরাও রাষ্ট্র প্রধানের পদে কোনো নারীকে অধিষ্ঠিত করা গ্রহনযোগ্য নয় বলে অবিহিত করেছেন। কেননা, ফয়সালা দানের ক্ষেত্রে এটা তো সম্ভব যে, তার এখতিয়ায়ের সীমা-পরিসীমাকে কিছু সংখ্যক মুআমালাতের সাথে খাস বনিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু ‘রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে’কে শরয়ী উসূল অনুযায়ী কিছু মুআমালাতের সীমা পরিসীমার সাথে খাস বানানো সম্ভব নয়’। [গায়াছুল আম্মাম, যুওয়াইনী- ৮২, ৮৩ পৃষ্ঠা]
রাণী বিলকীসের ঘটনা
আমাদের এযুগের কেউ কেউ রাণী বিলকীসের ওই ঘটনার আশ্রয়েও ‘নারী নেতৃতে’র বৈধতা বেড় করে নেয়ার চেষ্টা করে থাকে, যে ঘটনাটিকে কুরআন কারীম ‘সূরা নমল’-এ বর্ণনা করেছে। অথচ এ কথাটি গ্রহনের একেবারেই অযোগ্য। কুরআন কারীমে বর্ণিত ওই ঘটনাটির সাহায্যে কেমন করে নারীর ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার বৈধতা প্রমাণিত হতে পারে?! কুরআন কারিম পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছে যে, রাণী বিলকীস ওইসকল অমুসলীমদের নেত্রী ছিল যারা সূর্য পুজা করতো। হুদহুদ পাখি হযরত সুলাইমান আ.-কে তার সম্পর্কে যে সংবাদ দিয়েছিল, কুরআন কারীমের বর্ণনা মতে সেই সংবাদটি ছিল এই-
وَجَدْتُهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُونَ لِلشَّمْسِ مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘আমি তার জাতিকে এমন অবস্থায় দেখে এসেছি যে, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যকে সিজদাহ করে থাকে’। [সূরা নমল ২৪]
এ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সে একটি ‘সূর্য পুজারী’ জাতির রাণী ছিল; খোদ্ নিজেও সূর্যের পুজা করতো। আর বলাই বাহুল্য, কোনো কাফের জাতি যদি কোনো নারীকে তাদের ‘জাতীয় নেত্রী’ বানিয়ে নেয়, তাহলে কুরআন সুন্নাহ’র পরিষ্কার বর্ণনাদির মোকাবেলায় সেটা মুসলমানদের জন্য কি করে দলিল সাব্যস্থ হতে পারে? যদি হযরত সুলাইমান আ. তাকে রাণী মেনে নিয়ে নিজের হুকুমত ও নেতৃত্ব তার কাঁধে সোপর্দ করে দিতেন, তাহলে তখন একথা প্রমাণিত হত যে, কম করে হলেও হযরত সুলাইমান আ.-এর শরীয়তে নারীও ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হতে পারতো। অথচ কুরআন কারীম পরিষ্কার বাক্যে বলে দিয়েছে যে, ব্যপারটা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হযরত সুলাইমান আ. বিলকীসের হুকুমতকে মেনে নেননি। বরং তিনি তার নামে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তা কুরআন কারীমের মুবারক ভাষ্য মতে ছিল এই-
أَلَّا تَعْلُوا عَلَيَّ وَأْتُونِي مُسْلِمِينَ
‘তোমরা আমার মুকাবেলায় মস্তক উঠিও না এবং আমার কাছে অনুগত (মুসলীম) হয়ে চলে এসো। [সূরা নমল ৩১]
এই বাক্যটি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, হযরত সুলাইমান আ. রাণী বিলকীসের হুকুমতকে যে মেনে নেন নি- ব্যপার শুধু তাই নয়, বরং তিনি তাকে অনুগত হয়ে চলে আসারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। তিনি তার পাঠানো উপহারও গ্রহন করেন নি, বরং সটা ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। অথচ দুজন ‘রাষ্ট্র প্রধানে’র মধ্যে উপহার উপঢৌকন আদান প্রদান করাটা একটা চিরাচরিত বিষয় হয়ে থাকে। কুরআন কারীম একথাও জানিয়ে দিয়েছে যে, হযরত সুলাইমান আ. রাণীর সিংহাসনটিকে পর্যন্ত অন্যের দ্বারা উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং এনে সেটার বৈশিষ্ট বদলে দিয়েছিলেন। এমন কি যখন রাণী বিলকীস হযরত সুলাইমান আ.-এর মহলে আসলো, তখন কুরআন কারীমের বর্ণনা মতে সে বলেছিল-
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘হে পরওয়ারদেগার! নিশ্চই আমি আমার নিজের উপর অবিচার করেছি। আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম’। [সূরা নমল ৪৪]
বাস্! ঘটনা কেবল এতটুকুই, যা কুরআন কারীম বর্ণনা করেছে, আর তাতে রানী বিলকীসের উক্ত বাক্যের মাধ্যমেই ঘটনাটির ইতি টানা হয়েছে। যে কোনো লোক কুরআন মজীদের উক্ত ঘটনার উপর দৃষ্টি বুলাবে, সে এই সিদ্ধান্তে উপনিত না হয়ে পারবে না যে, ‘হযরত সুলাইমান আ. রানী বিলকীসের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে মেনে নেন নি। বরং তিনি তাকে নিজের কাছে আত্বসমর্পন করে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন কি এর সাথে তিনি তার বাদশাহীর পরিসমাপ্তিও ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তদুপরি খোদ্ রানী বিলকীসই হযরত সুলাইমান আ.-এর দরবারে পৌছার পর নিজের আত্মসমর্পণের কথা ঘোষনা দিয়েছিল।
এই ঘটনার কোনো এক স্থানেও এমন দূরবর্তী কোনো কথার সংমিশ্রন পর্যন্ত বিদ্যমান নেই যে, হযরত সুলাইমান আ. রাণী বিলকীসের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে বৈধ বলেছেন কিংবা সেটাকে মেনে নিয়েছেন।
কোনো কোনো ব্যক্তি কিছু ইসরাঈলী বর্ণনা পেশ করে থাকে যে, হযরত সুলাইমান আ. রাণী বিলকীসকে বিয়ে করে তাকে ইয়েমেনে পঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওগুলো একদমই অগ্রহনযোগ্য বর্ণনা। কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা একথা প্রমাণিত নয়। এ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো মারাত্মক দ্বন্দ্বপূর্ণ। কোনোটিতে আছে যে, সুলাইমান আ. তাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রেখেছিলেন। কোনোটিতে আছে, তাকে শামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কোনোটিতে আছে ইয়েমেন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবার কোনোটিতে আছে যে, হামদানের বাদশাহ’র সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। ইমাম কুরতুবী রহ. (মৃঃ ৬৭১ হিঃ ) এসমস্ত অগ্রহনযোগ্য রেওয়ায়েতগুলি উল্লেখ করার পর লিখেছেন-
لم يرد فيه خبر صحيح لا في انه تزوجها و لا فى انه زوجها
‘এ সম্পর্কে কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। না এ ব্যপারে যে, তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন, আর না এ ব্যপারে যে, তিনি অন্য কারো সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন’। [তাফসীরে কুরতুবী]
যখন রাণী বিলকীসের ইসলাম গ্রহনের পরবর্তী ঘটনাবলি বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত নয়, তখন সোজা সাপটা রাস্তা এছাড়া আর কি আছে যে, কুরআন কারীম যতটুকু ঘটনা বর্ণনা করেছে, কেবলমাত্র ততটুকু ঘটনার উপরই ঈমান রাখা হবে! আর বলা বাহুল্য, এই ঘটনার মধ্যে রাণী বিলকীসের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বাকি রাখার কথা নয়, বরং তার আত্মসমর্পণের কথাই উল্লেখ আছে। এখানে তার ইসলাম গ্রহনের পর তাকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বানানোর কোনো উল্লেখ নেই। কাজেই এ ঘটনা থেকে নারী নেতৃত্বের স্বপক্ষে দলিল উপস্থাপনের সামান্য কোনো বৈধতাও বিদ্যমান নেই।
হযরত আয়েশা রা. এবং জামাল যুদ্ধ
কেউ কেউ ‘জামাল’ যুদ্ধের ঘটনা দ্বারা নারী নেতৃত্বের স্বপক্ষে দলিল পেশ করতে গিয়ে একথাও বলে থাকে যে, ‘উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. উক্ত যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন’!!! অথচ বাস্তবতা এই যে, হযরত আয়েশা রা. কখনই ‘খিলাফত’ বা ‘রাষ্ট্রীয় নেতৃতে’¡র দাবী করেন নি, আর না তার সমর্থকদের অতিভক্তিমাখা মনমানসিকতায় এ বিষয়টি বিদ্যমান ছিল যে, তাঁকে খলীফা বানাতে হবে। হযরত আয়েশা রা. কেবল এতটুকুই চেয়েছিলেন যে, হযরত ওসমান রা.-এর হত্যাকারীদের থেকে قصاص (কিসাস) নেয়াটা কুরআন কারীমের বিধান মোতাবেক জরুরী। হযরত ওসমান রা. যখন শহীদ হন, তখন রাসুলে কারীম সা.-এর সকল স্ত্রী মহোদয়া হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররমায় এসেছিলেন। হযরত আয়েশা রা. সহ অন্যান্য নবীপত্নীগণ প্রথম দিকে এই চেয়েছিলেন যে, তাঁরা পবিত্র মদীনায় ফিরে গিয়ে হযরত আলী রা.-কে ‘কিসাস’ বিধান কার্যকর করাতে রাজি করাবেন। কিন্তু বহু লোক এই অভিমত ব্যক্ত করলো যে, আগে (ইরাকের) বসরা’য় গিয়ে সেখানকার জনগণের আনুকুল্যতা অর্জন করা হোক। এতে অন্যান্য নবীপত্নীগণ বসরা যেতে অস্বীকার করে বলে দিলেনঃ আমরা মদীনা মুনাওয়ারা ছাড়া অন্য আর কোথাও যাবো না। কিন্তু হযরত আয়েশা রা. ওইসকল লোকদের অভিমত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বসরা অভিমুখে রওনা দিলেন। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাছীর- ৭/২৩০]
হযরত আয়েশা রা.-এর যুদ্ধ করাও উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তিনি যখন বসরা যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে এক জায়গায় তাবু ফেলা হল। রাতের বেলায় সেখানে কুকুর ভুগতে আরম্ভ করলো। হযরত আয়েশা রা. লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘এটা কোন জায়গা’? লোকেরা বললো- ‘এ জায়গার নাম حواب (হাউআব)’। ‘হাউআব’ নামটি শুনতেই হযরত আয়েশা রা. চমকে উঠলেন। রাসুলে করীম সা.-এর একটি কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। রাসুলুল্লাহ ﷺ একদিন তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-
كيف باحد اكن تنبح عليها كلاب الحواب
‘তখন তোমাদের একজনের কি অবস্থা হবে, যখন তার উপর ‘হাউআব’-এর কুকুর ভুগতে শুরু করবে!’ [মুসনাদে আহমদ- ৬/৫২, ৯৭; মুসতাদরাকে হাকীম- ৩/১২০; ফতহুল বারী- ১৩/৪৫; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৬/২১২]
হযরত আয়েশা রা. ‘হাউআব’ নামটি শোনা মাত্রই সামনে এগুতে অস্বীকার করে বসলেন, আর তাঁর সঙ্গী সাথীদেরকে এই বলে চাপ দিতে লাগলেন যে, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। এমনকি একদিন একরাত সেখানেই রয়ে গেলেন। কিন্তু কেউ কেউ বললোঃ আপনি চলুন; আপনার কারনে মুসলমানদের দুটি দলের মধ্যে সংশোধন হবে। আর কোনো কোনো বর্ণনায় আছে যে, কেউ কেউ তার কাছে অস্বীকার করে বললো যে, এ জায়গাটা ‘হাউআব’ নয়। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/ ২৩১] পরে ভাগ্যে যা হবার ছিল, তাই হল। হযরত আয়েশা রা. আবার এগুতে শুরু করলেন। বসরা গিয়ে পৌছার পরও তাকে যখন বসরায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করা হল, তখন তিনি বললেন-
اى بنى, الا صلاح بين الناس
‘ব্যাটা! আমি মানুষের মাঝে সংশোধন করিয়ে দিতে এসেছি।’
এসব কথা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত আয়েশার রা. উদ্দেশ্য না ছিল রাজনীতি, না হুকুমত, আর না তিনি যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বরং হযরত ওসমান রা.-এর ‘কিসাস’ গ্রহনের বৈধ দাবিতে শক্তি যোগানো এবং এর ক্রমধারায় মুসলমানদের মাঝে সংশোধনের এক খাঁটি দ্বীনী উদ্দেশ্যই ছিল তার দৃষ্টির সামনে।
এতদ্বসত্ত্বেও হযরত আয়েশা রা. যেহেতু মুসলীম নারী জাতির গ্রহনযোগ্য কর্মসীমা থেকে কিছুটা বাইরে বেড়িয়ে সামষ্টিক ব্যপারগুলোর মধ্যে পা রেখেছিলেন, তাই সাহাবায়ে কেরাম সহ খোদ্ উম্মাতুল মু’মিনীনও তার এসব পদক্ষেপ গ্রহন করাকে পছন্দ করেন নি। অনেক সাহাবাই রা. তাকে পত্র লিখেছিলেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা রা. তাঁকে ওই অবস্থায় একটি বড়ই প্রভাবসৃষ্টিকারী চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি নিম্নরূপ-
عن ام سلمة زوج النبى صل الله عليه و سلم الى عائشة ام المؤمنين فانى احمد اليك الله الذى لا اله الا هو اما بعد انك سدة بين رسول الله صل الله عليه و سلم و امته و حجاب مضروب على حرمته قد جمع قران ذيلك فلا تندحيه و سكدخفارتك فلا تبتذها فالله من وراء هذه الامة ولو علم رسول الله صل الله عليه و سلم ان النساء يحتملن الجهاد عهد اليك اما علمت انه قد نهاك عن الفراطه فى البلاد فان عمود الدين لا يثبت بالنساء ان مال و لا يراببهن ان انصدع جهاد النساء غض الاطراف ضم الذبول و قصد الوهازة ما كنت قائلة لرسول الله صلى الله عليه وسلم لو عاصك ببعص هذه الفلوات ناصة قعودا من منهل الى منهل و غدا تردين على رسول الله صلى الله عليه و سلم و اقسم لو قيل لى يا ام سلمت ادخلى الجنة لا ستحييت ان القى رسول الله صلى الله عليه و سلم هاتكت حجابا ضربه على فاجعليه سترك و قاعة البيت حصنك فانك انصح ما تكونين لهذه الامة ما تعدت عن نصرتهم- العقد الفريد ص٦٦/ج٥ ٠ مطبوعه دار الباز مكه مكرمه
‘নবীয়ে করীম ﷺ-এর স্ত্রী উম্মে সালমা’র পক্ষ থেকে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশার নামে। আমি আপনার কাছে ওই আল্লাহ’র শোকর আদায় করছি, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। অতঃপর আরোজ এই যে- আপনি রাসুলে করীম সা. ও তাঁর উম্মতের মাঝে দরজা স্বরূপ। আপনি হলেন সেই পর্দা, যা তাঁর মানমর্যাদার উপর স্থাপন করা হয়েছে। কুরআন আপনার যে আচলকে সংকুচিত করে দিয়েছে, আপনি সেই আচলকে ছড়িয়ে দিবেন না। আপনার মর্যাদা রক্ষা করুন। রাসুলুল্লাহ ﷺ যদি একথা জানতে পেতেন যে, নারী জাতির উপর জীহাদের দায়িত্ব বর্তায়, তাহলে তিনি আপনাকে তার ওসিয়ত করে যেতেন। কেনো, আপনার কি জানা নেই যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ আপনাকে শহরে শহরে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলেন? কেননা, যদি দ্বীনের স্তম্ভ নড়ে যায়, তাহলে সেটা নারীদের সাহায্যে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না; আর যদি তাতে ফাটল ধরে, তাহলে নারীদের মাধ্যমে তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। নারী জাতির জীহাদ হল -সে দৃষ্টিকে বাঁচিয়ে চলবে, আর ছোট ছোট কদমে হাটবে। আপনি যেসব ময়দানে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে আপনার উটকে দৌড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, যদি সেখানে আপনার সামনে রাসুলুল্লাহ ﷺ এসে যেতেন, তখন তাঁর সামনে আপনার বলবার মত কি থাকতো? কাল আপনাকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে যেতে হবে! আমি শপথ করে বলছি, আমাকে যদি বলা হয়, ‘হে উম্মে সালমা! জান্নাতে প্রবেশ করো,’ তবুও এতে আমার লজ্জাবোধ হবে যে, আমি রাসুলে করীম ﷺ-এর সাথে এমতাবস্থায় সাক্ষাত করবো যে, তিনি আমার উপর যে পর্দা ফেলেছিলেন আমি সেটাকে ছিড়ে ফেলেছি! তাই একেই আপনি পর্দা বানিয়ে নিন, আর নিজের ঘরের চার দেয়ালকেই আপনার দূর্গ মনে করুন। কেননা, যে পর্যন্ত আপনি আপনার ঘরে থাকবেন, সেটাই হবে এ উম্মাহ’র জন্য সর্ব বৃহৎ কল্যান কামনা। [আল ইক্বদুল ফরীদ- ৫/৬৬]
উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা রা.-এর উপরোক্ত পত্রের এক একটি বক্তব্য থেকে দ্বীন ইসলামের ওই পবিত্র ভাবগাম্ভির্যোতা টপকে টপকে পড়ছে, যা নারীকে মান-মর্যাদা ও পবিত্রতার উচ্চতর স্তর দান করেছে এবং যার সামনে রাজনৈতিক সমস্ত পদমর্যাদা ও পাথীর্ব শানশওকত মূল্যহীন।
হযরত আয়েশাও হযরত উম্মে সালমার কোনো কথাকে অস্বীকার করেন নি। বরং তার উপদেশকে নিয়মানুগভাবে গ্রহন করে নিয়েছেন এবং এই বলে তার মর্যাদা দিয়েছেন যে-
فما اقبلنى لوعظك و اعرفنى لحق نصيحتك
‘আমি আপনার উপদেশকে যথাযত ভাবে গ্রহন করেছি। আর আপনার উপদেশ দানের অধিকার সম্পর্কে আমি ভাল করেই জানি’।
অবশ্য তিনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেছেন-
و لنعم المطلع مطلع فرقت فيه بين فئتين متشاجرتين من المسل
‘আর ওই অবস্থান গ্রহন খুবই উত্তম অবস্থান, যার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত দু’টি দলের মাঝে আমি প্রাচীর স্বরূপ হতে পারবো।’
এ থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, হযরত আয়েশা রা. না রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আকাঙ্খি ছিলেন, না জীহাদের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল, আর না কোনো রাজনৈতিক আসন ছিল তার উদ্দেশ্য। বরং তাঁর দৃষ্টি ছিল দু’টি দলের মাঝে সংশোধন করিয়ে দেয়া। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
فان اقعد ففى غير حرج و ان ان امض فالى مالا غنى لى عن الازدياد منه
‘এখন আমি যদি বসেও যাই, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। আর যদি সামনে অগ্রসর হই, তাহলে এমন এক কাজের জন্য অগ্রসর হবো, যাকে বেশি করে সম্পন্ন করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই’। [আল ইক্বদুল ফরীদ- ৫/৬৬]
এত সাবধানতা সত্ত্বেও সে যুগটি তো ছিল ফেতনারই যুগ! শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত গরম মস্তিষ্ক দ্বারা আঞ্জাম পাচ্ছিল, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মাঝে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া। যাহোক, ভাগ্যে যা ছিল ঘটে গেল। ‘জামাল’ যুদ্ধ সংঘটিত হল। সেসময় হযরত আয়েশা রা. এমন এক অবস্থানে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন, যেখান থেকে তিনি আর ফেরত আসতে পারেন নি।
হযরত উম্মে সালমা রা. ছাড়াও আরো অনেক সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁকে গৃহের বহির্ভাগের দায়দায়িত্ব সম্পাদন করা থেকে বাধা দিয়েছিলেন। যেমন, হযরত যায়েদ বিন সওহান রা. হযরত আয়েশা রা.-কে এক পত্রে লিখেছিলেন-
سلام عليك اما بعد فانك امرت بامر و امرنا بغيره امرت ان تقرى فى بيتك و امرنا ان نقاتل الناس حتى لا تكون فتنة فتركت ما امرت به و كتبت تنهيننا عما امرنا به و اسلام
‘আপনার প্রতি সালাম। অতঃপর আরোজ এই যে, আপনাকে একটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আর আমাদেরকে দেয়া হয়েছে অন্য আরেকটি বিষয়ের নির্দেশ। আপনাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আপনি যেন ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকেন। আর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমরা যেন মানুষের সাথে ওই পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই, যতক্ষন পর্যন্ত না ফেতনা নির্মূল হয়ে যায়। আপনি আপনার কাজ পরিত্যাগ করেছেন। আর আমাদেরকে ওই কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখছেন, যে কাজের জন্য আমরা নির্দেশিত। ওয়াস- সালাম। [আল ইক্বদুল ফরীদ- ৫/৬৭]
কথা এখানেই শেষ নয়, স্বয়ং হযরত আয়েশা রা. পরবর্তীতে তার এই কাজের উপর যার পর নাই অনুতাপ প্রকাশ করতেন। ইমাম শামসুদ্দীন যাহবী রহঃ (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) লিখেছেন-
و لا ريب ان عائشت ندمت ندامت كلية على مسيرها الى البصرة وحضروها يوم الجمل و ما ظنت ان الأمر يبلغ ما بلغ
‘আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, হযরত আয়েশা রা. তাঁর বসরার সফর এবং জামাল যদ্ধে উপস্থিতির উপর দারুনভাবে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি যে, ঘটনা এতদূর গিয়ে গড়াবে’। [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহবী- ২/১৭৭]
ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) নিজ সনদে এই বর্ণনা উদ্ধত করেছেন যে, একবার হযরত আয়েশা রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর’কে বললেন- তুমি আমাকে ওই সফরে যেতে বাধা দাওনি কেনো? হযরত ইবনে ওমর রা. বললেন- ‘আমি দেখলাম যে, এক ব্যক্তি (তথা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.) আপনার মতামতের উপর প্রাধান্য লাভ করে ফেলেছেন।’ হযরত আয়েশা রা. জবাবে বললেন- ‘তুমি যদি বাধা দিতে, তাহলে আমি বেড় হতাম না’। [নসবুর রায়া, যাইলায়ী- ৪/৭০]
‘জামাল’ যুদ্ধ ও তার সফরের জন্যে হযরত আয়েশা সিদ্দীকার অনুতাপের জগৎ এই ছিল যে, তিনি কুরআনে কারীম তেলাওয়াতর সময় যখন সূরা আহযাবের নিম্নোক্ত আয়াতে গিয়ে উপনীত হতেন, যেখানে আল্লাহ তাআলা স্ত্রীগনকে এই আদেশ দিয়েছেন যে-
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ
‘তোমরা তোমাদের নিজ নিজ ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকো’।
-তখন তিনি এত কাঁদতেন যে, অশ্রুতে তাঁর ওড়না ভিজে যেতো। [ত্ববাকাতে ইবনে সা’দ- ৮/৮০; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- ২/ ১৭৭ ]
[ইমাম হাকেম নিশাপুরী রহ. (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়েশা রা. দুঃখ করে বলতেনঃ ‘আমি যদি হারীছ বিন হীশামের মত দশ দশটি সুপুত্র গর্ভে ধারন করে একে একে তাদের সকলকেই হারাতাম এবং নিজ হাতে দাফন দিতাম, তবুও আমার এত অনুতাপ হত না, যে অনুতাপ ও মনকষ্ট আজ আমাকে ইবনে যুবায়ের সহ অন্যান্য সাহাবীদের সঙ্গে বসরায় যাওয়ার কারণে পোহাতে হচ্ছে।’ [মুসতাদরাকে হাকীম- ৩/১১৯]- অনুবাদক]
তাঁর অনুতাপের চরম অবস্থা এই ছিল যে, প্রথম দিকে তাঁর কমনা ছিল, তাকে যেন নিজ ঘরে দু’জাহানের সর্দার রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে দাফন করানো হয়। কিন্তু ‘জামাল’ যুদ্ধের পর তিনি তাঁর এ ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করেন। হযরত কায়েস বিন আবি হাযাম বর্ণনা করেন-
قالت عائشة رضى الله عنها و كان تحدث نفسها ان تدفن فى بيتها مع رسول الله صلى الله عليه و سلم و ابى بكر فقالت انى احدثت بعد رسول الله صلى الله عليه و سلم حدثا ادفنى مع ازواجه ، فدفنت بالبقيع – مستدرق الحاكم: ص٦/ج٤، قال الحاكم هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ، و وفقه اذهبى
‘হযরত আয়েশা রা. বলেছিলেন, তার অন্তরের বাসনা এই যে, তাঁকে তাঁর নিজের ঘরে রাসুলে করীম ﷺ এবং (পিতা) হযরত আবু বকর রা.-এর সাথে দফন করা হোক। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেনঃ আমি রাসুলে করীম ﷺ-এর পর একটি ‘বিদআত’ সংঘটিত করে ফেলেছি। আমাকে তাঁর অন্য স্ত্রীদের সাথেই দাফন দিয়ে দিও।’ পরে তাকে ‘জান্নাতুল বাকী’তে দাফন করা হয়। [মুসতাদরাকে হাকীম- ৪/৬]
হযরত আয়েশা রা.-র উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম যাহবী রহ. বলেন-
تعنى بالحديث مسيرها يوم الجهل فانها ندمت ندامة كلية و تابت من ذلك على انها ما فعلت ذلك الا متاولة قاصدة للخير
‘বিদআত’ দ্বারা হযরত আয়েশা সিদ্দীকার উদ্দেশ্য হল তার ‘জামাল’ যুদ্ধে যাওয়ার ব্যপারটি। কেননা, তিনি তাঁর ওই কাজের জন্য সাংঘাতিক মাত্রায় অনুতপ্ত ছিলেন এবং এ থেকে তওবা করেছিলেন, যদিও বা তার এ পদক্ষেপ ইজতিহাদের ভিত্তিতেই ছিল এবং তার উদ্দেশ্য ছিল নেক। [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- ২/১৯৩]
এ সমস্ত ঘটনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত আয়েশা রা. না কখনো রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আকাঙ্খা করেছিলেন, না এর দাবি তুলেছিলেন, আর না কেউ এ অভিমত উপস্থাপন করেছিল যে, ‘তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হোক’, আর না তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কোনো ভাবে যুদ্ধের নেতৃত্বে দান করা। তিনি শুধুমাত্র কুরআন কারীমের একটি বিধান বাস্তবায়ন এবং মুসলমানদের মাঝে সমঝোতা করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শত্রুদের চক্রান্ত তাঁর ওই সফরকে শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের আকার দান করে। কিন্তুু তাঁর মিশনটি যেহেতু সামষ্টিক বিচারে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত রাজনৈতিক বৈশিষ্টের ধারক ছিল, এজন্য সাহাবায়ে কেরামগনও তাঁর এ অবস্থানকে পছন্দ করেন নি। আর খোদ্ তিনিও চরম ভাবে অনুতপ্ত ছিলেন। এমনকি ওই অনুতপ্ততার কারনে রাসুলে কারীম ﷺ-এর রওজায় নিজের দাফন হওয়াটাকেও তিনি পছন্দ করেন নি।
এখন নিজেই ইনসাফের সাথে ফয়সালা করে দেখুন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. তাঁর নিজের যে পদক্ষেপকে শেষ তক্ ভুল মনে করলেন, যার জন্য কান্নাকাটি করলেন এবং যার উপর অনুতপ্ত হয়ে রাসুলে করীম ﷺ-এর নিকটে দাফন হতেও লজ্জাবোধ করলেন, সেই কাজ দ্বারা কি করে দলিল পেশ করা যেতে পারে? আর দলিল দানটাও আবার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের বৈধতার উপর, যার কল্পনা হযরত আয়েশা সিদ্দীকার উঁকি দেয়া কল্পনাতেও কখনো আসেনি!
হাকীমুল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর ব্যাখ্যা সম্পর্কিত আলোচনা
আমাদের এ যুগের কেউ কেউ নারী নেতৃত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে মওলানা আশরাফ আলী সাহেব থানভী রহ.-এর একটি ব্যাখ্যাকেও পেশ করার চেষ্টা করে থাকে, যা ‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’য় বর্ণিত হয়েছে। সেখানে হযরত থানভী রহ. لن يفلح قوم ولوا امرهم امراة -‘ওই জাতি কক্ষোনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না, যে জাতি তার বিষয়গুলোকে নারীর দায়িত্বে সোপর্দ করে দেয়’ -এই হাদীসের ব্যপারে একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে একথা বলেছেন যে, ‘জমহুরী হুকুমত’ (গণতান্ত্রীক সরকার ব্যবস্থা) হাদীসের উক্ত ধমকির আওতায় পরে না’।
কিন্তু হযরত থানভী রহ.-এর উক্ত বক্তব্য বোঝার আগে একথা জেনে নেয়া জরুরী যে, হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. গোটা উম্মাহ’র উলামায়ে কেরামের ন্যয় একথাই বলেছেন যে, ‘নারীকে ইসলামী ‘রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান’ বানানো জায়েয নয়’। খোদ্ ‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’র উক্ত আলোচনার মধ্যেই স্বয়ং থানভী রহ. লিখেছেন যে-
حضرات فقھاءنے امامت کبرى (حکومت کى سربراھے) ميے ذكوره (مرد هونے) کو شرط صحت, اور قضا ميے گو شرط صحت نهيے, مگر شرط صون عن الاثم فرمايا هے
‘ফিকাহবীদ উলামায়ে কেরামগন বলেছেন, ‘ইমামতে-কুবরা’ (বড় ইমামত তথা রাষ্ট্র প্রধানত্ব) সহীহ হওয়ার জন্য ‘পুরুষ’ হওয়া শর্ত। তবে বিচার সহীহ হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত নয় বটে, কিন্তু তা পাপ থেকে পরহেজ থাকার প্রশ্নে একটি শর্ত। [ইমদাদুল ফাতাওয়া, থানভী- ৫/ ৯২]
এমনকি হযরত থানভী রহ. তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এই মাসআলাটিকে আরো পরিষ্কার করে এভাবে বর্ণনা করেছেন-
اور همارے شريعت ميے عورت كو بادشاه بنانے كى ممانعت هے پس بلقيس کے قصه سے کوئ شبه نه کرے اول تو يه فعل مشركين كا تها دوسرے اگر شريعت سليمانيه نے اس کے تقرير بهى كى هو تو شرع محمدى ميے اس کے جلاف هوتے هوئے وه حجت نهيے
‘আর আমাদের শরীয়তে নারীকে বাদশাহ (রাষ্ট্র প্রধান) বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই রাণী বিলকীসের ঘটনা দ্বারা কোনো সন্দেহে পতিত হবেন না। প্রথমতঃ তো এ কাজটি করেছিল মুশরেকরা, দ্বিতীয়তঃ হযরত সুলাইমান আ.-এর শরীয়ত যদি ওই কাজটিকে মেনে নিয়েও থাকে, তবুও তা মুহাম্মাদী শরীয়তের পরিপন্থী বিধায় সেটা কোনো ‘হুজ্জত’ (দলিল) নয়’। [তাফসীরে বয়ানুল কুরআন, থানভী- ৮/৮৫]
এমনকি হযরত থানভী রহ. ‘আহকামুল কুরআন’-এর যে অংশটি হযরত মওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী সাহেব রহ.-এর মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করিয়ে নিয়েছেন, তাতেও রাণী বিলকীসের ঘটনার অধিনে এ মাসআলাটিকে পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেন। সেখানে -‘কুরআন কারীম বিলকীসের ঘটনা বর্ণনা করে এর উপর কোনো সমালোচনা করেনি’-এমন কথা দ্বারা দলিল দানকে খোদ্ হযরত থানভী রহ.-এর সূত্রেই রদ্ করে দেয়া হয়েছে। [আহকামুল কুরআন, মুফতী শফী- ৩/ ২৯]
হযরত থানভী রহ.-এর এ সমস্ত বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ওলামায়ে উম্মতের ন্যয় তিনিও এ কথার প্রবক্তা ছিলেন যে, ‘নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বাননো শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়েয’।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে যে, (নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বাননো নাজায়েয হওয়া সত্ত্বেও) কোথাও যদি শরীয়তের এই বিধানকে উপেক্ষা করে কোনো নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে ফেলাই হয়, তাহলে হাদীসে পাকে যে এই মর্মে বর্ণিত হয়েছে যে- ‘ওই জাতি কক্ষোনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না’ -সেই ধম্কী ও সাবধানবানী কি তথাকার জনমানুষের উপর আরোপিত হবে? এর জবাবে হযরত থানভী রহ. বলেছেন যে, সরকারটি যদি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ ও ব্যপক সরকার হয় -যেমনটা হয়ে থাকে ব্যক্তিকেন্দ্রীক বাদশাহদের বেলায় (কিংবা হয়ে থাকে ইসলামী খেলাফতের বেলায়; এবং কোনো নারীকে যদি এরকম সরকারের নেত্রী বা প্রধান বানিয়ে দেওয়া হয়) তাহলে কোনো সন্দেহ ছাড়াই তাদের উপর হাদীসের ধমকী ও সাবধানবানী আরোপিত হবে। কিন্তু সরকারটি যদি গণতান্ত্রীক (জমহুরী) আঙ্গিকে গঠিত হয়, তাহলে (হাদীসে বর্ণিত) ‘সফলতা অজর্ন না করা’র বিষয়টি’ অবধারিত হয়ে যায় না। এর কারণ স্বরূপ হযরত থানভী রহ. বলেছেন-
راز اس مي يہ هے كہ حقيقت اس حكومت كى محض مشوره اور عورت اهل هے مشوره كى
‘এর পেছনে মূল কারণ এই যে, ‘গনতান্ত্রীক’ সরকার-ব্যবস্থার হাকিকত (মৌলিক বৈশিষ্ট) হল নিছক পরামর্শ দান, (অর্থাৎ, পার্লামেন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রের কোনো ব্যপারে একক কর্তৃত্ব খাটানোর অধিকার রাখে না। বরং কোনো কিছু করার ব্যপারে তারা পার্লামেন্টে নিজ নিজ মতামত বা পরামর্শ পেশ করে, পরে অধিকাংশের পরামর্শমূলক সিদ্ধান্ত যেদিকে যায়, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সবাই বাধ্য থাকে)। আর (এদৃষ্টিকোণ থেকে পার্লামেন্টের কোনো সদস্য) নারী (হলে, সেও পুরুষদের মত) এর একজন পরামর্শদাতা (হিসেবেই ভূমীকা পালন করে) মাত্র’। [ইমদাদুল ফাতাওয়া, থানবী ৫/৯২]
উপরের এ কথা থেকে একদম স্পষ্ট হয়ে যায় যে, থানভী রহ. (নারীর অধীনস্ত) সরকারকে যে নাজায়েযই বলেছেন- কথা শুধু তা-ই নয়, বরং তিনি একে (হাদীসে বর্ণিত) ‘সফলতা অর্জনে’র পরিপন্থী বলেও আখ্যায়ীত করছেন। সুতরাং মূল মাসআলার গন্ডিসীমা পর্যন্ত তাঁর মতামতগত অবস্থান এটাই যে, নারী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না। তবে ‘গনতান্ত্রীক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ সম্পর্কে তিনি এই ধারনা দান করেছেন যে, (নিছক তাঁর মতে) ‘গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ আসলে কোনো হুকুমত নয়, বরং নিছক পরামর্শ দান (সংক্রান্ত ব্যবস্থা) মাত্র।
তাই, হযরত থানভী রহ.-এর গোটা আলোচনার ভিত্তিই হল একথাকে কেন্দ্র করে যে, ‘গণতান্ত্রীক সরকার’ আসল ‘সরকার’ কি-না, (অর্থাৎ, ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা কিংবা রাজা-বাদশাহদের সরকার ব্যবস্থায় যেমন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক কর্তৃত্ব থাকে, তেমনি গণতান্ত্রীক সরকার ব্যবস্থায় সরকারপ্রধানের হাতেও মৌলিক কর্তৃত্ব থাকে কিনা), নাকি তা নিছক এশটি পরামর্শ দান (সংক্রান্ত ব্যবস্থা মাত্র, যেখানে সরকারপ্রধানও পার্লামেন্টের অন্যান্য সদস্যদের মত শুধুমাত্র পরামর্শ দানের ক্ষমতাই রাখে; কর্তৃত্ব খাটানোর কোনো ক্ষমতা রাখে না)’? আর (বলা বাহুল্য,) এ প্রশ্নটি ‘শরীয়তের বিধান’ সংক্রান্ত নয়, (কারণ, সকল ওলামায়ে কেরামের ন্যয় হযরত থানভী রহ.-ও এ আকিদাই পোষন করেন যে, শরীয়তের বিধান হল নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো নাজায়েয), বরং (প্রশ্নটি হল) সরকারের বৈশিষ্ট ও প্রকৃতি সংক্রান্ত। হযরত থানভী রহ. ‘গণতান্ত্রীক সরকারে’র কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সম্পর্কে (অজানা বসতঃ) এই ধারনা করে নিয়েছেন যে, মূলতঃ এটা কোনো নেতৃত্ব নয়, বরং পার্লামেন্টের একজন সদস্য হবার কারনে উক্ত নারীর কোনো ‘কথা’ নিছক একটা পরামর্শের বৈশিষ্ট রাখে মাত্র। যেমন উক্ত আলোচনায় তিনি বলেছেন-
کسى عورت كى سلطنت جمہورى هو كہ اس مے والىء صورى در حقيقت والى نہيى بلكہ ايك ركن مشوره هے اور والىء حقيقى مجموعہ مشيرون كا هے
‘একজন নারীর কর্তৃত্ব এক্ষেত্রে ‘গণতান্ত্রীক’ হয়ে থাকে। অর্থাৎ এপর্যায়ে বাহ্যতঃ তাকে (তার দল ও দশের) ওলী (অবিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক) মনে হলেও সে আসলে কোনো ওলী নয়; বরং পরামর্শ দানের একজন সদস্য মাত্র। আর প্রকৃত ওলী (অবিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক) বলতে বুঝায় তাকে, যে বিভিন্ন গোষ্ঠির (একক) নেত্রী হয়’। [ইমদাদুল ফাতাওয়া, থানবী- ৫/৯১]
এ অভিমত থেকে আবারও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, হযরত থানভী রহ. নারীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ‘নাজায়েয’ হওয়া এবং তাতে করে অবধারিত ভাবে ‘সফলতা অর্জন না করা’র বিষয়টির সাথে একাত্বতা প্রকাশ করছেন। কোনোই দ্বিমত নেই তার এ ব্যপারে। অপরদিকে ‘গণতান্ত্রীক সরকার ব্যবস্থা’র নেতৃত্বকে তিনি তাঁর নিজ জানা-শোনার ভিত্তিতে আসল নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বলে মনে করছেন না। বস্তুতঃ তার এ মতভিন্নতাটুকু (নারী নেতৃত্ব নাজায়েয হওয়া না-হওয়ার) মূল মাসআলা নিয়ে নয়, বরং ‘গণতান্ত্রীক সরকারব্যবস্থা’র বৈশিষ্ট ও প্রকৃতি নিয়ে।
আসল ব্যপার হল, পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় ‘প্রধানমন্ত্রী’ পার্লামেন্টের একজন সদস্য হওয়ার সুবাদে যদিও-বা পরামর্শ দানের একজন সদস্য মাত্র, কিন্তু তার আরো দুটি বৈশিষ্ট রয়েছে, যে বৈশিষ্টের বিদ্যমানতায় তাকে নিছক পরামর্শদানের একজন সদস্য বলে অবিহিত করা সম্ভব নয়। প্রথম বৈশিষ্টটা হল, ‘প্রধানমন্ত্রী’ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাথা বা প্রধান হয়ে থাকেন এবং তিনি তার এই বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে আইন কানুনের গন্ডির মধ্যে বিদ্যমান থেকেই সম্পূর্ণ রূপে একজন ‘নিজ এখতিয়ার সম্পন্ন’ ব্যক্তিত্ব। এমন কি, তার এই এখতিয়ারও অর্জিত আছে যে, তিনি (কোনো কোনো ক্ষেত্রে) গোটা মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শকে রদ করে দিয়ে তার নিজ রায় বা সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করতে পারেন।
বস্তুতঃ ‘গণতান্ত্রীক’ রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি কাজকে আলাদা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। একটি কাজ হল- ‘আইন রচনা করা’, যা আইনপ্রনেতা তথা পার্লামেন্টের উপর সোপর্দিত; দ্বিতীয় কাজ হল- রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করা, যা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের উপর সোপর্দিত; আর তৃতীয় কাজ হল বিবাদ বিষম্বাদের বিচার ফয়সালা করা, যা আদালতের উপর সোপর্দিত রয়েছে। এখন রাষ্ট্রের এই তিনটি প্রতিষ্ঠান তথা পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা এবং আদালতী ব্যবস্থাপনার মধ্যে ‘সরকার’ (হুকুমত) কথাটির সম্পর্ক মূলতঃ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনার উপরই আরোপিত হয়। পার্লামেন্ট ও বিচারব্যবস্থা অবশ্যই রাষ্ট্রের (State) অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তা ‘সরকার’ (Government)-এর অংশ নয়। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকেই ‘হুকুমত’ বা ‘সরকার’ বলা হয়ে থাকে এবং প্রধানমন্ত্রী হল উক্ত ব্যবস্থাপনার প্রধান পরিচালক। আইনের গন্ডির অধীনে থেকেই সরকারী কাজ কারবার পরিচালনা করার পূর্ণ এখতিয়ার তার অর্জিত আছে। না তিনি প্রত্যেকটি বিষয়কে পার্লামেন্টের পরামর্শের জন্য পেশ করেন, না করতে পারেন, আর না তা করতে তিনি বাধ্য। তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত মন্ত্রী পরিষদ বা মন্ত্রনালয়ের কাছে রাখেন বটে, কিন্তু (সবক্ষেত্রে) মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত মানতে তিনি বাধ্য নন। বরং মন্ত্রীপরিষদের সভাগুলোতে তার সিদ্ধান্তই ওজনদার ও পরিপক্ক (حتمى) সিদ্ধান্ত পরিগ্রহ করে থাকে। বলাই বাহুল্য যে, এ রকম এখতিয়ার সম্পন্ন ব্যক্তিকে নিছক ‘পরামর্শের সদস্য বলা যেতে পারে না।
পার্লামেন্টের হদ্-সীমায় নিঃসন্দেহে তিনি পরামর্শের একজন সদস্য। তবে পার্লামেন্টারী পার্টিগুলির প্রচলিত ব্যবস্থায় তার আরো একটি বৈশিষ্ট রয়েছে, যে বৈশিষ্টটি তাকে পার্লামেন্টের মধ্যেও নিছক পরামর্শের একজন সদস্য হিসেবে থাকতে দেয় নি। সে বৈশিষ্টটি হল, তিনি পার্লামেন্টে অধিকাংশ জনগণ দ্বারা সমর্থীত একটি দলের একজন ক্ষমতা সম্পন্ন লিডার ও দলপ্রধান হয়ে থাকেন। তাই পার্লামেন্টে তার কোনো সিদ্ধান্ত নিছক একটি ব্যক্তি কেন্দ্রীক সিদ্ধান্ত পরিগ্রহ করে না। বরং বেশির ভাগ সময় তার সিদ্ধান্তই দলের অধিকাংশের সিদ্ধান্তের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ করে, তিনি যদি তার নিজ দলের পার্লামেন্টারী সদস্যদের জন্য দলের পক্ষ থেকে কোনো দিক নির্দেশিকা জারি করে দেন, তাহলে তার দলের সমস্ত সদস্য এজেম্বলীতে উক্ত দিক নির্দেশিকা মোতাবেক ভোট দিতে বাধ্য থাকেন। পার্লামেন্টারী পরিভাষায় এই দিক নির্দেশিকাকে বলা হয় দলীয় চাবুক (Party Whip)। অর্থাৎ উক্ত চাবুককে কার্যকর করার পর দলের সকল সদস্য পার্লামেন্টে ওই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করতেই বাধ্য থাকেন, যে সিদ্ধান্তের জন্য উক্ত চাবুককে ব্যবহারে আনা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি এই চাবুক কার্যকর করেন, তাকে নিছক পরামর্শের একজন সদস্য বলা যায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে পার্লামেন্টের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর বৈশিষ্ট ও অবস্থান কেবল একজন ‘পরামর্শদাতা সদস্য পরিগ্রহ করে না; বরং দলের সংগঠক ও দল প্রধানের বৈশিষ্ট পরিগ্রহ করে। আর বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি অন্যান্যদের পরামর্শে কম এবং অন্যান্যরাই তার পরামর্শে চলে থাকে বেশি।
মতবাদগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেসিডেন্ট (রাষ্ট্রপতি) যদিও রাষ্ট্রের কর্তা ও প্রধান হয়ে থাকে, আর প্রধানমন্ত্রী থাকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান পরিচালক হিসেবে, কিন্তু পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের বৈশিষ্ট অনেকটা প্রদর্শনী ও আরম্বরী স্বরূপই হয়ে থাকে; আর মূল এখতিয়ার ও ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই। এজন্য (পার্লমেন্টারী রাষ্ট্রব্যবস্থায়) গোটা দুনিয়ার চোখে প্রধানমন্ত্রীকেই আসল হর্তাকর্তা মনে করা হয়ে থাকে।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত থানভী রহ. নারী নেতৃত্বকে কক্ষোনই জায়েয মনে করতেন না। এর স্বপক্ষে তার পরিষ্কার বক্তব্য মওজুদ রয়েছে। তবে প্রশ্ন এই ছিল যে, গণতান্ত্রীক সরকারের নেতৃত্বকে মৌলিক নেতৃত্ব বলা যায় কি না? এ প্রশ্নের সম্পর্ক শরীয়তের (মাসআলাহ) খতিয়ে দেখার সাথে নয়, বরং প্রচলীত গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট খতিয়ে দেখার সাথে। আর বলা বাহুল্য, হযরত থানভী রহ.-এর আসল আলোচ্য বিষয় ছিল শরীয়তের তাহক্বীক্ব ও গবেষনা লব্দ বিশ্লেষন। বর্তমান জামানার রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহকে খতিয়ে দেখা হযরত থানভী রহ.-এর বিষয়বস্তু ছিল না।
বলা বাহুল্য, পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার ‘প্রধানমন্ত্রী’ সম্পর্কে উপরে যে তাত্ত্বিক আলোচনা পেশ করা হল, সেটা যদি হযরত থানভী রহ.-এর সামনে পেশ করা হত, তাহলে ‘প্রধানমন্ত্রী নিছক পরামর্শের একজন সদস্য’ -এ মর্মে প্রদত্ত তার রায়ের উপর অবশ্যই তিনি পুনঃদৃষ্টি বুলাতেন।
ইতিহাসের কিছু উদাহরণ
কেউ কেউ নারী নেতৃত্বের বৈধতা প্রমাণ করতে গিয়ে ইতিহাসের কিছু উদাহরণ পেশ করে থাকেন যে, অমুক অমুক স্থানে অমুক নারী ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বলাবাহুল্য, জায়েয নাজায়েয সব রকম ঘটনাই ইতিহাসে ঘটেছে। দ্বীন ইসলামে ওসব ঘটনা কোনো দলিলই নয়। দলিল হল কুরআন ও সুন্নাহ। কাজেই কোথাও যদি নারী নেতৃত্বের ছিটে-ফোটা কিছু ঘটনা ঘটে থাকেও, তবুও সেসব ঘটনার উপর ভিত্তি করে কুরআন-সুন্নাহ’র সুস্পষ্ট বিধান ও দলিলসমূহকে পরিত্যাগ করা যেতে পারে না। তদুপরি ওসব ছিটে-ফোটা ঘটনাগুলোর অধিকাংশই এমন যে, মুসলমান সমাজ ওরকম সরকারকে আমলেই নেয়নি। এমন কি এক সময় সেই সরকার খতম হয়ে গেছে। তাছাড়া ওসব সরকারের আমলগুলোতেও এমন কোনো ঘটনার কথা পাওয়া যায় না যে, কোনো আলেম বা ফকীহ্ নারী-নেতৃত্বকে জায়েয বলে ফাতওয়া দিয়েছেন।
… যাহোক, নারী নেতৃত্ব নাজায়েয হওয়াটা এমন একটি স্বীকৃত মাসআলা, যা কুরআন সুন্নাহ’র পরিষ্কার বক্তব্য এবং ইজমার উপর স্থাপিত। উম্মাহ’র কোনো একজন ফকীহ বা আলেমও এ ব্যপারে দ্বিমত ব্যক্ত করেন নি।…তাই কোনো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো কোনোমতেই জায়েয নয়। আর কোথাও যদি এমনটা ঘটে যায়, তাহলে মুসলীম সমাজের জন্য কর্তব্য হল, তারা যত দ্রুত সম্ভব এরকম সরকারকে পরিবর্তন করার জন্য যথাসম্ভাব্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। والله سبحانه الموفق
মুহাম্মাদ রফী উসমানী (আফাল্লাহু আনহু)
খাদেম, ত্বলাবাহ, দারুল উলুম, করাচী 
তথ্য সূত্রঃ: Quora

কোন মন্তব্য নেই