সবমিলিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তন্মধ্যে হযরত খাদীজা ও যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। বা...
সবমিলিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তন্মধ্যে হযরত খাদীজা ও যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। বাকী ৯ জন স্ত্রী রেখে তিনি মারা যান। যারা হলেন যথাক্রমে হযরত সওদা, আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ, যয়নব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়াহ, উম্মে হাবীবাহ, ছাফিইয়াহ ও মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ)।
এতদ্ব্যতীত আরও দু’জন মহিলার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সহবাসের পূর্বেই তারা পরিত্যক্ত হন। প্রথমজন আসমা বিনতে নু‘মান আল-কিনদিয়াহ। যিনি ‘জাউনিয়াহ’ (الْجَوْنِيَّةُ) বলেও পরিচিত (ফাৎহুল বারী হা/৫২৫৫-এর ব্যাখ্যা)। তাকে কিছু মাল-সম্পদ দিয়ে বিদায় করা হয়। দ্বিতীয়জন ‘আমরাহ বিনতে ইয়াযীদ আল-কিলাবিয়াহ।[বুখারী হা/৫২৫৪-৫৫; ইবনু হিশাম ২/৬৪৭]
এছাড়াও তাঁর দু’জন দাসী ছিল। একজন খ্রিষ্টান কন্যা মারিয়া ক্বিবত্বিয়াহ। যাকে মিসররাজ মুক্বাউক্বিস হাদিয়াস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। অন্যজন ইহূদী কন্যা রায়হানা বিনতে যায়েদ আল-কুরাযিয়াহ। ইনি বনু কুরাইজার যুদ্ধে বন্দী হন। আবু ওবায়দাহ আরও দু’জন দাসীর কথা বলেছেন। যাদের একজন জামীলা। যিনি কোন এক যুদ্ধের বন্দীনী ছিলেন। অন্যজন তাঁর স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) কর্তৃক হেবাকৃত।[আর-রাহীক্ব ৪৭৩-৭৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১০২]
তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে কুরায়শী ছিলেন ৬ জন। যারা ছিলেন বিভিন্ন কুরায়েশ গোত্রের। যেমন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ আল-আসাদী, আয়েশা বিনতে আবুবকর আত-তামীমী, হাফছাহ বিনতে উমর আল-‘আদাভী, উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান আল-উমুভী, উম্মু সালামাহ বিনতে আবু উমাইয়া মাখযূমী ও সাওদা বিনতে যাম‘আহ আল-‘আমেরী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না)। স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র ইহূদী কন্যা ছিলেন ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব। ইহূদী ও খ্রিষ্টান কন্যারা সবাই ইসলাম কবুল করেন।
নবীপত্নীগণের মর্যাদা :
━━━━━━━━━━━━━
১. পবিত্র কুরআনে তাঁদেরকে يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ ‘হে নবীপত্নীগণ’ বলে সম্বোধন করে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে (আহযাব ৩৩/৩০, ৩২)। অন্যত্র أَزْوَاجِكَ ‘তোমার স্ত্রীগণ’ (আহযাব ৩৩/২৮, ৫৯; তাহরীম ৬৬/১-২) বলা হয়েছে। ‘যাওজ’ (زَوْجٌ) অর্থ জোড়া, সমতুল্য, সমপর্যায়ভুক্ত বস্ত্ত। যেমন বলা হয়, زَوْجَا خُفٍّ ‘মোযার দু’টি জোড়া’। রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রীগণকে তাঁর أَزْوَاج বলার মাধ্যমে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। অথচ امْرَأَةٌ (স্ত্রী) শব্দ বলা হয়নি, যা অন্যান্য নবী এবং নবী নন এমন সকলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে (তাহরীম ৬৬/১০)। যেমন- হযরত নূহ ও লূত (আঃ)-এর স্ত্রীদের ক্ষেত্রে امْرَأَتَ نُوْحٍ وَامْرَأَتَ لُوْطٍ ‘নূহের স্ত্রী, লূত্বের স্ত্রী’ বলা হয়েছে। অন্যদিকে ফেরাঊনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে, امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ (তাহরীম ৬৬/১১) এবং আবু লাহাবের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ (লাহাব ১১১/৪) বলা হয়েছে। ইবরাহীমের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ বা ‘তার স্ত্রী’ (যারিয়াত ৫১/২৯) এবং أَهْلَ الْبَيْتِ বা ‘পরিবার’ (হূদ ১১/৭৩) বলে দু’ধরনের শব্দ এসেছে। তবে যাকারিয়ার স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتِيْ (মারিয়াম ১৯/৫) এবং زَوْجَهُ (আম্বিয়া ২১/৯০) দু’টি শব্দ এসেছে। কিন্তু শেষনবীর স্ত্রীগণের ক্ষেত্রে কেবল أَزْوَاج শব্দ খাছ করার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদাকে অন্য সকলের উপর বিশেষভাবে উন্নীত করা হয়েছে।
২. নবীপত্নীগণের মর্যাদা পৃথিবীর সকল মহিলার উপরে। যেমন আল্লাহ বলেন, لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ‘তোমরা অন্য কোন মহিলার মত নও’ (আহযাব ৩৩/৩২)। এখানে كَأَحَدٍ শব্দ ব্যবহার করায় নবী ও নবী নন, সকলের স্ত্রী ও সকল মহিলাকে বুঝানো হয়েছে। নবীপত্নীগণের উচ্চ মর্যাদায় স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এই অনন্য সনদ নিঃসন্দেহে গৌরবের এবং একই সাথে মুসলিম উম্মাহর জন্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় বিষয়।
৩. আল্লাহ নবীপত্নীগণকে নিষ্কলংক ঘোষণা করেছেন এবং তাদের গৃহকে সকল প্রকারের আবিলতা ও পংকিলতা হতে মুক্ত বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র করতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।
৪. আল্লাহ নবীপত্নীগণের গৃহগুলিকে ‘অহীর অবতরণ স্থল’ (مَهْبِطُ الْوَحْيِ) হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যা তাঁদের মর্যাদাকে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ إِنَّ اللهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ‘আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং হিকমতের (হাদীছের) কথাসমূহ, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, সেগুলি তোমরা স্মরণ রাখ। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে অবহিত’ (আহযাব ৩৩/৩৪)।
৫. নবীর মৃত্যুর পরে তাঁরা সকলের জন্য ‘হারাম’ এবং তাঁরা ‘উম্মতের মা’(وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ) হিসাবে চিরদিনের জন্য বরণীয় হয়েছেন (আহযাব ৩৩/৫৩; ৩৩/৬)। সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত এই মর্যাদা পৃথিবীর কোন মহিলার ভাগ্যে হয়নি। অতএব সত্যিকারের মুমিন সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিজের জীবনের চাইতে ভালবাসেন এবং তাঁর স্ত্রীগণকে মায়ের মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন করেন।
৬. প্রথমা স্ত্রী খাদীজা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ ‘জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম’।[আহমাদ হা/২৬৬৮; মিশকাত হা/৬১৮১]
(ক) খাদীজা (রাঃ) ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল নিজের পক্ষ হতে ও আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম দেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মুক্তাখচিত প্রাসাদের সুসংবাদ দেন।[বুখারী হা/১৭৯২, ৩৮২০; মুসলিম হা/২৪৩৩] (খ) স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-কে জিব্রীল (আঃ) রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম পাঠান এবং তিনিও তার সালামের জওয়াব দেন (বুখারী হা/৬২০১)। তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় (বুখারী হা/৩৬৬২)।
এক নযরে উম্মাহাতুল মুমিনীন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১. খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ) : বিবাহকালে রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ২৫ ও তাঁর বয়স ৪০; মৃত্যুসন- রামাযান ১০ম নববী বর্ষ; দাফন- মক্কার ‘হাজূনে’; মৃত্যুকালে বয়স ৬৫। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর দাম্পত্যকাল- ২৪ বছর ৬ মাস বা প্রায় ২৫ বছর। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
জ্ঞাতব্য : পূর্বে তিনি দুই স্বামী হারান। প্রথম স্বামী ছিলেন উতাইয়িক্ব বিন ‘আবেদ বিন আব্দুল্লাহ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে এক ছেলে আব্দুল্লাহ ও এক মেয়ে জন্ম নেয় (ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৪)। তার মৃত্যুর পর ২য় স্বামী আবু হালাহ বিন মালেক তামীমী-এর ঔরসে হালাহ, তাহের ও হিন্দ নামে ৩ পুত্র ছিল। যারা সবাই পরে সাহাবী হন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১০৮৬, ৮৯১৯, ৪২৩৮, ৯০১৩)। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্বামী এবং তিনি ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। রাসূল (সাঃ)-এর ঔরসে তাঁর দুই ছেলে ক্বাসেম ও আব্দুল্লাহ ও চার মেয়ে যয়নব, রুক্বাইয়াহ, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান ক্বাসেমের নামেই তাঁর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। পুত্র আব্দুল্লাহর লক্বব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের’ (ইবনু হিশাম ১/১৯০)। জাহেলী যুগে খাদীজা ‘ত্বাহেরাহ’ (طَاهِرَةٌ) অর্থ ‘পবিত্রা’ নামে এবং ইসলামী যুগে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ (صِدِّيْقَةٌ) অর্থ ‘নবুঅতের সত্যতায় প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারিণী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫২৫০; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৮১৮] প্রথমা ও বড় স্ত্রী হিসাবে তিনি ‘খাদীজাতুল কুবরা’ নামেও পরিচিত।
২. সওদা বিনতে যাম‘আহ (سَوْدَةُ بِنْتُ زَمْعَةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫০, তাঁর বয়স ৫০, বিবাহ সন- শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ, মৃত্যুসন- ১৯ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দাম্পত্য জীবন- ১৪ বছর। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : ইনি প্রথমদিকে ইসলাম কবুল করেন। পরে তাঁর উৎসাহে স্বামী সাকরান বিন ‘আমর মুসলমান হন। অতঃপর উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। সাকরান সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সন্তানদের নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সওদা চরম বিপাকে পড়েন। একই সময়ে খাদীজাকে হারিয়ে বিপদগ্রস্ত রাসূল (সাঃ) বাধ্য হয়ে সংসারে পটু সওদাকে বিয়ে করেন ও তার হাতে সদ্য মাতৃহারা সন্তানদের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৫টি। তন্মধ্যে ১টি বুখারীতে ও ৪টি সুনানে আরবা‘আহতে।
উল্লেখ্য যে, সাকরান হাবশায় গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে নাছারা হন ও সেখানে মৃত্যুবরণ করেন মর্মে ত্বাবারী ও ইবনুল আছীর যে বর্ণনা করেছেন, তা সহীহ বা যঈফ কোনভাবেই প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৪-৪৫)।
৩. আয়েশা বিনতে আবুবকর (عَائِشَةُ بِنْتُ أَبى بَكْرٍ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৪, বিবাহ সন- শাওয়াল ১১ নববী বর্ষ। বিয়ের সময় বয়স ৬, স্বামীগৃহে আগমনের বয়স ৯, শাওয়াল ১ হিজরী, মৃত্যুসন- ৫৭ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স- ৬৩। দাম্পত্য জীবন-১০ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনিই একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। কোন সন্তানাদি হয়নি। নবীপত্নীগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও হাদীছজ্ঞ মহিলা। জ্যেষ্ঠ সাহাবীগণ বিভিন্ন ফাৎওয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন ও তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতেন (যাদুল মা‘আদ ১/১০৩)। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন, আমি কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ৫৪টি এককভাবে বুখারী ও ৯টি এককভাবে মুসলিম। বাকী ১৯৭৩টি মুসনাদে আহমাদ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।[1]
উল্লেখ্য যে, আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা আবুবকর (রাঃ) ছিলেন একমাত্র সাহাবী, যাঁর পরিবারে চারটি স্তরের সবাই মুসলমান ছিলেন। যা অন্য কোন সাহাবীর মধ্যে পাওয়া যায় না’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৫৯)। অর্থাৎ আবুবকর (রাঃ) নিজে, তাঁর পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যাগণ এবং তাদের সন্তানগণ।
৪. হাফছাহ বিনতে উমর(حَفْصَةُ بِنْتُ عُمَرَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৫, তাঁর বয়স ২২, বিবাহ শা‘বান ৩ হিজরী; মৃত্যুসন-৪১হি.; দাফন- মদীনা; বয়স-৫৯। দাম্পত্য জীবন- ৮ বছর।
জ্ঞাতব্য : তাঁর পূর্ব স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ সাহ্মী প্রথমে হাবশা ও পরে মদীনায় হিজরত করেন। বদর ও ওহুদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। ওহুদে যখমী হয়ে মারা যান। পরে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে হাফছার বিয়ে হয়। তিনি মোট ৬০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৪টি, এককভাবে মুসলিম ৬টি। বাকী ৫০টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে। প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই।
৫. যয়নব বিনতে খুযায়মা (زَيْنَبُ بِنْتُ خُزَيْمَةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৫; তাঁর বয়স প্রায় ৩০; বিবাহ সন ৩ হিজরী; মৃত্যুসন ৩ হি., বয়স ৩০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন ২ অথবা ৩ মাস।
জ্ঞাতব্য : পরপর দুই স্বামী হারিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশের সাথে তৃতীয় বিবাহ হয়। কিন্তু তিনি ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হলে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে চতুর্থ বিবাহ হয়। অধিক দানশীল ও গরীবের দরদী হিসাবে তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা ‘মিসকীনদের মা’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি কোন হাদীছ বর্ণনা করেননি।
৬. উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়াহ (أُمُّ سَلَمَةَ هِنْدٌ بِنْتُ أَبِي أُمَيَّةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৬; তাঁর বয়স ২৬; বিবাহ সন ৪ হি.; মৃত্যুসন ৬০ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৮০ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৭ বছর। স্ত্রীদের মধ্যে তিনি সবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (সাঃ)-এর আপন ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহর স্ত্রী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। আবু সালামাহ বদর ও ওহুদ যুদ্ধে শরীক হন। ওহুদে যখমী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে উম্মে সালামাহ রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। তাঁর দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয় (বুখারী হা/২৭৩২)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৩৭৮। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১৩, এককভাবে বুখারী ৩টি, মুসলিম ১৩টি। বাকী ৩৪৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৭. যয়নব বিনতে জাহশ (زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ সন ৫হি. মৃত্যুসন ২০হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৫১ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (সাঃ)-এর ফুফাতো বোন ছিলেন। প্রথমে রাসূল (সাঃ)-এর পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর সাথে বিবাহ হয়। পরে যায়েদ তালাক দিলে আল্লাহর হুকুমে তিনি তাকে বিয়ে করেন প্রচলিত দু’টি কুসংস্কার দূর করার জন্য। এক- সে যুগে পোষ্যপুত্রকে নিজ পুত্র এবং তার স্ত্রীকে নিজ পুত্রবধু মনে করা হত ও তার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ মনে করা হত। দুই- ইহূদী ও নাছারাগণ ওযায়ের ও ঈসাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করত (তওবা ৯/৩০)। অথচ সৃষ্টি কখনো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তান হতে পারে না। যেমন অপরের ঔরসজাত সন্তান কখনো নিজের সন্তান হতে পারে না।
তিনি মোট ১১টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২১৮)।
৮. জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (جُوَيْرِيَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ২০; বিবাহ শা‘বান ৫হি.; মৃত্যু সন ৫৬হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭১। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি বনু মুছত্বালিক্ব নেতা হারেছ বিন আবু যাররাবের কন্যা ছিলেন। ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে বন্দী হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন এবং রাসূল (সাঃ)-এর শ্বশুরকুল হওয়ার সুবাদে একশ’-এর অধিক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। জুওয়াইরিয়ার প্রথম স্বামী ছিলেন মুসাফিহ বিন সুফিয়ান মুছতালিক্বী। তিনি মোট ৭টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে বুখারী ২টি, মুসলিম ২টি। বাকী ৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৯. উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান (أُمُّ حَبِيبَةَ رَمْلَةُ بِنْتِ أبي سُفْيَانَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৮; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ মুহাররম ৭হি.; মৃত্যু সন- ৪৪হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী তার প্রথম স্বামী ছিলেন। উভয়ে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী মারা যান। তিনি একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিধবা হন। রাসূল (সাঃ) তার চরম বিপদের কথা জানতে পেরে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীর মাধ্যমে বাদশাহ নাজাশীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন ও তার সাথে বিবাহের পয়গাম পাঠান। নাজাশী স্বয়ং তার বিবাহের খুৎবা পাঠ করেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষে ৪০০ দীনার মোহরানা পরিশোধ করেন ও সবাইকে দাওয়াত খাওয়ান। পরে তাঁকে রাসূল (সাঃ)-এর প্রেরিত দূত শুরাহবীল বিন হাসানাহ (রাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় পাঠিয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, রামলাহ ক্রমিক ১১১৮৫)। তিনি ৬৫টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি ও মুসলিম ১টি। বাকী ৬২টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
উল্লেখ্য যে, ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ হাবশায় গিয়ে ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হয়ে গিয়েছিলেন ও উক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন’ বলে যে ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে, তা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে ইবনু সা‘দ যে বর্ণনা এনেছেন তা ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৩৭-৪৩)। মুবারকপুরীও তার ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, যা যঈফ (আর-রাহীক্ব ৪৭৪ পৃঃ, ঐ, তা‘লীক্ব ১৮৬-৯২ পৃঃ)।
১০. ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব (صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَىِّ بنِ أَخْطَبَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ১৭; বিবাহ ছফর ৭হি.; মৃত্যুর সন ৫০ হি.; বয়স ৬০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইসলাম কবুল করে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহূদী বনী নাযীর গোত্রের সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব-এর কন্যা এবং অন্যতম সর্দার কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্ব-এর স্ত্রী ছিলেন। উভয়ে নিহত হন। হযরত হারূণ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি ১০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীদের মধ্যে ইনিই ছিলেন একমাত্র ইহূদী কন্যা।
১১. মায়মূনা বিনতুল হারেছ (مَيْمُونَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ যুলক্বা‘দাহ ৭ হি.; মৃত্যুর সন ৫১ হি.; দাফন মক্কার নিকটবর্তী ‘সারিফে’; বয়স ৮০। দাম্পত্য জীবন- সোয়া তিন বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও খালেদ বিন অলীদ (রাঃ)-এর আপন খালা ছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মার সহোদর বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন। যিনি ইতিপূর্বে ৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্বের দুই স্বামী মারা গেলে ভগ্নিপতি হযরত আববাস (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন। ফলে ৭ম হিজরীতে ক্বাযা উমরাহ শেষে ফেরার সময় মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম-এর নিকটবর্তী ‘সারিফ’ (السَرِف) নামক স্থানে উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়। এটিই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ বিবাহ। তিনি মোট ৭৬টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৭টি, এককভাবে বুখারী ১টি, মুসলিম ৫টি। বাকী ৬৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।[2]
ইসলামে তাঁদের অবদান :
━━━━━━━━━━━━━━━
মুসলিম উম্মাহর জন্য উম্মাহাতুল মুমিনীন-এর সবচাইতে বড় অবদান এই যে, তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠ জাতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সেই সাথে পেয়েছে অন্যূন ২৮২২টি হাদীছ। সেগুলির মধ্যে একা আয়েশা (রাঃ) ২২১০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যা মুসলিম উম্মাহর জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিক নির্দেশিকা ধ্রুবতারার ন্যায় সর্বদা পথ দেখিয়ে থাকে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একাধিক বিবাহ পর্যালোচনা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
জানা আবশ্যক যে, ২৫ বছরের টগবগে যৌবনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিবাহ করেন পরপর দুই স্বামী হারা বিধবা ও কয়েকটি সন্তানের মা ৪০ বছরের একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে। এই স্ত্রীর মৃত্যুকাল অবধি দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তাকে নিয়েই সংসার করেছেন। অতঃপর ৬৫ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যু হলে তিনি নিজের ৫০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আর এক ৫০ বছর বয়সী কয়েকটি সন্তানের মা একজন বিধবা মহিলা সাওদাকে নিতান্তই সাংসারিক প্রয়োজনে। এরপর মক্কা হতে হিজরত করে তিনি মদীনায় চলে যান। যেখানে শুরু হয় ইসলামী সমাজ গঠনের জীবন-মরণ পরীক্ষা। ফলে মাদানী জীবনের দশ বছরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে ও ইসলামের বিধানসমূহ বাস্তবায়নের মহতী উদ্দেশ্যে আল্লাহর হুকুমে তাঁকে আরও কয়েকটি বিবাহ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, চারটির অধিক স্ত্রী একত্রে রাখার অনুমতি আল্লাহপাক স্রেফ তাঁর রাসূলকে দিয়েছিলেন। অন্য কোন মুসলিমের জন্য নয় (আহযাব ৩৩/৫০)।
আরও উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, مَا لِى فِى النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ ‘আমার জন্য মহিলার কোন প্রয়োজন নেই’ (বুখারী হা/৫০২৯)। প্রশ্ন হল, তাহলে কেন তিনি এতগুলো বিয়ে করলেন? এর জওয়াবে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পেশ করব।-
১ম কারণ: শত্রু দমনের স্বার্থে (لدفع الأعداء) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল এই যে, তারা জামাতা সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। জামাতার সঙ্গে যুদ্ধ করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারটি ছিল তাদের নিকটে দারুণ লজ্জা ও অসম্মানের ব্যাপার। তাই আল্লাহ পাক স্বীয় নবীকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন বর্বর বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করার কৌশল হিসাবে। যা দারুণ কার্যকর প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ।-
(ক) ৪র্থ হিজরীতে উম্মে সালামাহকে বিবাহ করার পর তাঁর গোত্র বনু মাখযূমের স্বনামধন্য বীর খালেদ বিন অলীদের যে দুর্ধর্ষ ভূমিকা ওহুদ যুদ্ধে দেখা গিয়েছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ৭ম হিজরীর শুরুতে তিনি মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন।
(খ) ৫ম হিজরীতে জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে বনু মুছত্বালিক্ব গোত্রের যুদ্ধবন্দী একশত জন ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং চরম বিরুদ্ধবাদী এই গোত্রটি মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়। জুওয়াইরিয়া (রাঃ) তার কওমের জন্য বড় ‘বরকত মন্ডিত মহিলা’ (كَانَتْ أَعْظَمَ بَرَكَةً) হিসাবে বরিত হন এবং তাঁর গোত্র রাসূল (সাঃ)-এর শ্বশুর গোত্র (أَصْهَارُ رَسُولِ اللهِ) হিসাবে সম্মানজনক পরিচিতি লাভ করে’ (আবুদাঊদ হা/৩৯৩১)।
(গ) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে উম্মে হাবীবাহকে বিবাহ করার পর তাঁর পিতা কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান আর রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেন না। বরং ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে তিনি ইসলাম কবুল করেন।
(ঘ) ৭ম হিজরীর ছফর মাসে ছাফিয়াকে বিবাহ করার ফলে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদীদের যুদ্ধ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধি করে তারা খায়বরে বসবাস করতে থাকে।
(ঙ) ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সর্বশেষ মায়মূনা বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে নাজদবাসীদের অব্যাহত শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। কেননা মায়মূনার এক বোন ছিলেন নাজদের সর্দারের স্ত্রী। এরপর থেকে উক্ত এলাকায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। অথচ ইতিপূর্বে এরাই ৪র্থ হিজরীতে ৭০ জন সাহাবীকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যা ‘বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা’ নামে প্রসিদ্ধ।
২য় কারণ: ইসলামী বন্ধন দৃঢ়করণ (تقوية صلة الإسلام) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আয়েশা ও হাফছাকে বিবাহ করার মাধ্যমে হযরত আবুবকর ও উমরের সঙ্গে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব দৃঢ়তর ভিত্তি লাভ করে। উসমান ও আলীকে জামাতা করার পিছনেও রাসূল (সাঃ)-এর অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে ইসলাম জগত চারজন মহান খলীফা লাভে ধন্য হয়।
৩য় কারণ: কুপ্রথা দূরীকরণ (إزالة الرسم الجاهلى) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
পোষ্যপুত্র নিজের পুত্রের ন্যায় এবং তার স্ত্রী নিজের পুত্রবধুর ন্যায় হারাম- এ মর্মে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক কুপ্রথার অপনোদনের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেন। এ বিষয়ে সূরা আহযাবের ৩৭ ও ৪০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। বস্ত্ততঃ এ বিষয়গুলি এমন ছিল যে, এসব কুপ্রথা ভাঙার জন্য কেবল উপদেশই যথেষ্ট ছিল না। তাই আল্লাহর হুকুমে স্বয়ং নবীকেই সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
৪র্থ কারণ : মহিলা সমাজে ইসলামের বিস্তার (انتشار الإسلام بين النساء) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাহেলী সমাজে মহিলারা ছিল পুরুষের তুলনায় আরো পশ্চাদপদ। তাই তাদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যোরদার করার জন্য মহিলা প্রশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ছিল সর্বাধিক। পর্দা ফরয হওয়ার পর এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। ফলে রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর সহযোগী হিসাবে একাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধিক স্ত্রী অর্থই ছিল অধিক প্রশিক্ষিকা। কেবল মহিলারাই নন, পুরুষ সাহাবীগণও বহু বিষয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের নিকট হতে হাদীছ জেনে নিতেন। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও মা আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ প্রমুখের ভূমিকা ছিল এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, একাধিক বিবাহ ব্যবস্থাকে যারা কটাক্ষ করতে চান, তাদের জানা উচিত যে, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য সবার প্রতি সমান ব্যবহারের শর্তে সর্বোচ্চ চার জন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাধ্য করেনি। পক্ষান্তরে আধুনিক সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্যের ফ্রি ষ্টাইল যৌন জীবনে অভ্যস্ত হতাশাগ্রস্ত সমাজ জীবনের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, সেখানে অশান্তির আগুন আর মনুষ্যত্বের খোলস ব্যতীত কিছুই নেই। অথচ প্রকৃত মুসলিমের পারিবারিক জীবন পরকালীন কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও নিষ্কাম ভালোবাসায় আপ্লুত থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবন যার বাস্তব দৃষ্টান্ত।
[1]. প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলতেন, خُذُوا شَطْرَ دِينِكُمْ عَنِ الْحُمَيْرَاءِ ‘তোমরা দ্বীনের অর্ধাংশ আয়েশার নিকট থেকে গ্রহণ করো’ (আল-বিদায়াহ ৩/১২৮)। হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল (আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১০)।
[2]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন, নকশা ২/১৮২, বিস্তারিত ২/১৪৪-৮১; ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৮; শাযাল ইয়াসমীন ফী ফাযায়েলে উম্মাহাতিল মুমিনীন, (কুয়েত : ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়, তাবি) ৩১-৩৪ পৃঃ।
কোন মন্তব্য নেই